ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার আর কোনও ইচ্ছা নেই ইউক্রেনের। দেশের দুই রুশপন্থী অঞ্চলকে ‘স্বাধীনতা’ দিতেও তারা রাজি। গত কাল ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এ কথা জানাতেই রাশিয়ার সুরও কিছুটা নরম শোনালো। এই প্রথম তাদের মুখে শোনা গেল, ইউক্রেন সরকারকে ‘ক্ষমতাচ্যুত’ করার ইচ্ছা নেই রাশিয়ার।
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন, ইউক্রেনে ক্ষমতাসীন সরকারের পতনের লক্ষ্য নিয়ে রুশ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে না। ইউক্রেন দখলের কোনো ইচ্ছা রাশিয়ার নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বুধবার মস্কোতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জাখারোভা বলেন, ‘রুশ সেনাদের লক্ষ্য ইউক্রেনের সরকারকে উচ্ছেদ করা নয়। ইউক্রেন দখল করা বা দেশটির বেসামরিক লোকজনের ক্ষয়ক্ষতির কোনো উদ্দেশ্য নিয়েও সেনারা এগোচ্ছে না’।
বরফ কি তবে গলছে? তিন দফায় শান্তি-বৈঠক করেছে ইউক্রেন ও রাশিয়া। এই প্রথম রাশিয়া জানাল, বৈঠকে বেশ কিছু সদর্থক ও ইতিবাচক উত্তর মিলেছে। ইউক্রেনের মুখেও ভিন্ন সুর। জেলেনস্কি বলেছেন, ‘ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার প্রসঙ্গে আমি অনেক আগেই ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছি… যখনই বুঝেছি, ইউক্রেনকে দলে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয় ন্যাটো’।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার ক্ষোভের অন্যতম কারণই হল, তাদের ন্যাটোতে যোগ দিতে চাওয়া। স্নায়ু যুদ্ধের শুরুতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকে ইউরোপকে রক্ষা করতে তৈরি হয়েছিল ‘ট্রান্সআটলান্টিক’ সামরিক জোট ন্যাটো। রাশিয়া চায়নি একদা সোভিয়েতের অন্তর্ভুক্ত দেশ ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিক। তা ছাড়া ন্যাটোর এভাবে আড়েবহরে আকার বৃদ্ধিও ভাল চোখে দেখছে না রাশিয়া। এর মধ্যে প্রতিবেশী ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার অর্থ রাশিয়ার দোরগোড়ায় তাদের সেনাবহরের উপস্থিতি। মস্কোর চোখে বিষয়টা ‘বিপজ্জনক’। এ নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি প্রকাশ করেছিল রাশিয়া। কিন্তু ইউক্রেন তা শোনেনি।
অন্য দিকে, ২০১৪ সাল থেকে কিয়েভের সঙ্গে ‘অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব’ চলছে পূর্ব ইউক্রেনের রুশপন্থী দুই অঞ্চল, দোনেৎস্ক এবং লুহানস্কের। ইউক্রেন আক্রমণ করার ঠিক আগে এই দুই অঞ্চলকে ‘স্বাধীন প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণা করেন পুতিন। তার দাবি, এই দুটি অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দিতে হবে ইউক্রেনকেও। অর্থাৎ তার ছোট্ট দেশটি ভেঙে আরও ছোট হবে। তাতে রাজি ছিলেন না জেলেনস্কি।
যদিও যুদ্ধের ১৪ দিন পরে, প্রায় ধ্বংসস্তূপের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নরম হতে বাধ্য হচ্ছেন। রাশিয়ার দাবির প্রসঙ্গে তিনি আজ বলেন, ‘কথা বলতে আমি রাজি। কিন্তু নিরাপত্তার নিশ্চয়তা থাকছে তো!’ জেলেনস্কির কথায়, ‘রাশিয়া ছাড়া আর কেউ এই দুই অঞ্চলকে প্রজাতান্ত্রিক দেশের মর্যাদা দেয়নি। কিন্তু আমি এ নিয়ে কথা বলতে রাজি। এই দুই অঞ্চলে মানুষ কী ভাবে বাঁচবে, সে নিয়ে সমঝোতা করতেও তৈরি। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হল, এই দুই অঞ্চলের বাসিন্দারা। এই অঞ্চলের কিছু মানুষ ইউক্রেনের সঙ্গে থাকতে চান, তারা কী বলবেন। ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দারা এই অঞ্চলকে সঙ্গে নিয়ে থাকতে চাইতে পারেন। তারা কী ভাবে বাঁচবেন! এদের নতুন পরিচিতিকে স্রেফ মান্যতা দিয়ে দিলেই তো হল না, প্রশ্ন আরও জটিল’। তিনি বলেন, ‘আমার আশা, শুধুমাত্র মিথ্যা তথ্যের বুদবুদের ভিতরে আটকে না থেকে পুতিন এ বিষয়ে কথা বলা শুরু করবেন’।
রাজনৈতিক সমঝোতার পাশাপাশি যুদ্ধ নিয়েও সাময়িক মীমাংসায় পৌঁছেছে দুই দেশ। বৃহস্পতিবার সারা দিনের জন্য যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে রাশিয়া ও ইউক্রেন। তবে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের জন্য। ইউক্রেনের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইরিনা ভেরেশচুক জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধ রাখার বিষয়ে কথা দিয়েছে মস্কো। এই সময়ে যুদ্ধে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ৭টি অঞ্চল (যার মধ্যে রয়েছে কিয়েভ, জাপোরিজিয়া ও উত্তরপূর্বের কিছু এলাকা) থেকে উদ্ধার করা হবে বাসিন্দাদের।
তবে মস্কোর মেজাজ নরম হলেও ইউক্রেনকে সাবধান থাকতে বলেছে ওয়াশিংটন। তাদের বক্তব্য, রাশিয়া যাই বলুক, তারা ইউক্রেনে আগ্রাসন বন্ধ করবে না। হয়েছেও তাই। যুদ্ধবিরতির মধ্যেই বুধবার মারিওপোলের একটি শিশু ও প্রসূতি হাসপাতালে বোমা ফেলেছে রাশিয়া।
শহরের কাউন্সিল একটি ভিডিও পোস্ট করে জানিয়েছে, হাসপাতালের যে অংশে শিশুদের চিকিৎসা হয়, সেটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে রুশরা। হতাহত এখনও স্পষ্ট নয়। জেলেনস্কি সোশ্যাল মিডিয়ায় বলেন, ‘ধ্বংসস্তূপের তলায় চাপা পড়ে রয়েছে শিশুরা, মায়েরা। নৃশংস! আর কত দিন এই বিশ্ব চুপচাপ এই সন্ত্রাস দেখে যাবে?’
এ ঘটনার নিন্দা করে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন, ‘দুর্বল, নিরস্ত্র, অসহায় মানুষকে হামলা করার মতো জঘন্য কাজ আর কিছু হয় না’। তার কথায়, ‘এর জবাব পুতিনকেই দিতে হবে। আকাশপথে হামলা ঠেকাতে আমরা ইউক্রেনকে আরও সাহায্য পাঠাব’।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এবং ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা তুরস্কে বৈঠকে বসেছেন। বৃহস্পতিবার (১০ মার্চ) স্থানীয় সময় সকালে এই বৈঠক শুরু হয়েছে। ইউক্রেনে রুশ সামরিক বাহিনীর হামলা শুরুর পর উভয় নেতার মধ্যে এটিই প্রথম বৈঠক।
ওদিকে ইউক্রেনে চলমান সামরিক অভিযানে যারা রুশ সেনাদের হামলা করবে, তাদেরকে নির্বিচারে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হবে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিন।
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ক্রেমলিনের প্রেস সেক্রেটারি ও মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ‘রুশ সেনাদের লক্ষ্য বেসামরিক স্থাপনা বা লোকজন নয়; কিন্তু (বেসামরিক) কোনো ব্যাক্তি বা গোষ্ঠী যদি আমদের সেনাবাহিনীকে হামলা করে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই তাকে বা তাদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নির্ধারণ করা হবে’।
পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোকে নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে দীর্ঘ ২ মাস ইউক্রেন সীমান্তে প্রায় দুই লাখ সেনা মোতায়েন রাখার পর গত ২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দুই ভূখণ্ড দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় রাশিয়া; এবং তার দুদিন পর, ২৪ মার্চ তারিখ ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
অভিযানের শুরুর দিকে কেবল ইউক্রেনের সামরিক স্থাপনা ও সামরিক বাহিনীকে লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছিল রাশিয়া; কিন্তু রুশ বাহিনীকে ঠেকাতে ইউক্রেনের সরকার সাধারণ বেসামরিক জনগণের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়, এবং বেসামরিক ও আবাসিক এলাকাগুলো থেকে রুশ সেনাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ ও গোলা নিক্ষেপ শুরু করে।
ফলে, বিপুলসংখ্যক রুশ সেনার মৃত্যু হয়েছে ইতোমধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বিবিসিকে জানিয়েছেন, অভিযানের গত দুই সপ্তাহে রুশ বাহিনীর ৬ হাজারেরও বেশি সেনা মৃত্যুবরণ করেছেন বলে ধারণা করছেন তারা।
বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলনে পেসকভ বলেন, ‘ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের বেসামরিক লোকজনকে অস্ত্র না চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যদি তারা অস্ত্র সংবরণ করে- সেক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব হবে’।