নির্বাচনের বাকি আরও দুই বছর। এরই মধ্যে রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে নয়া চাঞ্চল্য। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও দেখা যাচ্ছে নানা তৎপরতা। এর মধ্যে কেউ জাতীয় সরকারের দাবি জানাচ্ছেন কেউ বলছেন আগে নির্দলীয় সরকার। এদিকে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে আগামী নির্বাচন নিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম জানিয়েছেন, আগে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। নির্বাচিত হলে আন্দোলনে থাকা সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠন করা হবে জাতীয় সরকার।
বিএনপি’র এ ঘোঘণার পর থেকেই রাজনীতিতে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। দলটির এই অবস্থানকে ইতিবাচক বলেই ভাবছে সরকারবিরোধী অন্যান্য দলগুলো।
বিএনপি অবস্থান পরিষ্কার করলেও তাদের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বিভিন্ন দল এবং বিলুপ্ত প্রায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের বক্তব্যে ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দল নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন-কর্মসূচি পালন করছে। বিএনপি জাতীয় সরকারের দাবির বিষয়ে একমত হয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়তে অন্য দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করেছিল আগেই।
কিন্তু হঠাৎ করে লন্ডনে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে যুক্তরাজ্য বিএনপি’র উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা সভায় দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জাতীয় সরকারের নতুন ধারণা দেন। এরপরই দলটির নেতাকর্মীরা বিষয়টি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সরব হন।
দলটির নেতারা বলছেন, তারেক রহমানের জাতীয় সরকারের ধারণাটি হলো, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। এ লক্ষ্যে যে আন্দোলন হবে সে আন্দোলনে যারা থাকবেন তারা নির্বাচনে বিজয়ী না হলেও তাদের সবাইকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে।
এদিকে বুধবার বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জাতীয় সরকার ও নিরপেক্ষ সরকার ইস্যুতে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ বৈঠকেও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের জাতীয় সরকারের নতুন ধারণাকে সমর্থন জানিয়ে উপস্থিত নেতারা বক্তব্য রাখেন। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের জাতীয় সরকারের নতুন ধারণা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হবে। এখন থেকে দলের বক্তব্য-বিবৃতিতে জাতীয় সরকারের নতুন ধারণার সুফল জনগণের মাঝে তুলে ধরা হবে।
এদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং তারপরে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য কীভাবে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হবে সে বিষয়ে নিশ্চয়ই আলাপ আলোচনা হবে। তবে এই আলোচনা কীভাবে হবে। বিএনপি অন্যদলকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে এমন প্রশ্ন রয়েছে সমমনা অন্যান্য দলের নেতাদের মাঝে।
নির্বাচন বিষয়ে বিরোধী জোটে মূলত দু’টি অবস্থান দেখা যাচ্ছে। এক- সকল দল মতের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকার। দুই-নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনকালীন সরকার। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচেনর পর থেকে জাতীয় সরকারের দাবি জানিয়ে আসছেন জাতীয় সমাতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ আরও অনেকে। তাদের ভাষ্য, কোনো বিষয়ে বারবার আন্দোলন করা যাবে না। বিগত দিনে যখন যে সরকারে এসেছে তারাই স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গিয়ে কেউ যাতে আর স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারে সেজন্য সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঢেলে সাজাতে হবে।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা শুরু থেকেই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলে আসছি। কারণ দলীয় সরকার থাকলে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না। আমাদের লক্ষ্য এই সরকারের পদত্যাগ বা পতন। এরপরে সরকার গঠনের সময় সবাইকে নিয়ে সরকার গঠন করবো। গণতন্ত্রের যে ক্ষতি হয়েছে এগুলো যাতে রিকভার করা যায়। তবে সরকার পতনের জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হবে বলে আশা করি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যাই হোক সবতো এই সরকারের পতন ঘটিয়েই করতে হবে। সো এই বিষয়েতো একমত সবাই।
আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আমাদের একটাই দাবি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। এই নির্বাচনে পরে ক্ষমতায় গেলে আন্দোলন সংগ্রামে যারা মাঠে থাকবে, সরকার গঠনে আমরা তাদের সহযোগিতা নেবো। এই সরকারের পতন বিএনপি’র একার পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা চাই সবার ঐকমত্য। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে এই স্বৈরাচারী সরকারকে বিদায় করতে হবে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, জাতীয় সরকারের প্রস্তাবনা প্রথমে আমরা দিয়েছি। যারা এটাকে সমর্থন করছে তাদের আমরা সাধুবাদ জানাই। নির্বাচন কীভাবে হবে, কর্মসূচি কীভাবে হবে, এই সরকার কতদিন থাকবে, এগুলো আন্দোলনে যারা জয়লাভ করবে সবাই মিলে সর্বদলীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে। এই মুহূর্তে এই সিদ্ধান্ত দেয়া একক দলের বিষয় না। সোজা কথা আমরা কোনো দলীয় সরকার চাই না।
গণসংহতি পরিষদের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, বিএনপি যে বিষয়টি বলেছে এটা আমি সংবাদমাধ্যমে দেখেছি। আলাপ আলোচনা করে আমরা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারবো। তবে এটা তো নির্বাচন পরবর্তী প্রশ্ন। নির্বাচনের প্রশ্নটি তো এখন মুখ্য। আগের প্রসঙ্গ হচ্ছে বাংলাদেশে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে হবে? এখন আমাদের যে বক্তব্য সেটা হচ্ছে- এই সরকারের পদত্যাগ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং বাংলাদেশে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। এসব করার জন্য কীভাবে দেশে একটি জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হবে সে বিষয়ে আলোচনা নিশ্চয়ই হতে পারে।
গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নুর বলেন, বিএনপির এ অবস্থানকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি। আমি যেটা কথা বলে বুঝতে পেরেছি, ৯০ সালে যেমন এরশাদ বিরোধী আন্দোলন হয়েছে তখন বলা হয়েছিল, আগে এরশাদের বিদায়। পরে যারা আন্দোলন করেছে তারা আলোচনা করে ঠিক করবে কীভাবে একটা অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে।
আমরা জাতীয় সরকারের কথা বলে আসছি। তবে এই কথায় আমরা অটল না যে, জাতীয় সরকারই আমাদের লক্ষ্য। আমরা চাই একটা অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটা জাতীয় সরকার বা একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যেটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হলে ভালো হয়। সেই জায়গা থেকে আমরা কথাগুলো বলে আসছি। আমরা এখন চেষ্টা করছি, সকল বিরোধী দলগুলোকে সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়, অবাধ সরকারের অধীনে নির্বাচন- এই মৌলিক ইস্যুতে আমাদের মাঠে নামতে হবে। কারণ টেবিলে আলোচনা করে কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম হয় না। আগে মাঠে নেমে তারপরে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, আমরা তো সব সময় বলে আসছি দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। আমরা দেখেছি নিরপেক্ষ সরকারের নামে বিভিন্নভাবে দলীয় লোকদের বসিয়ে কাহিনী করা হয়। এটা বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের আমলে হয়েছে। এজন্য আমরা বলেছি সকল দলের মতামত নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করার। আর পার্লামেন্ট রেখে দেশে কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
পেশাজীবীদের সমাবেশ ঘিরে নানা আলোচনা: বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান ও সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদের নেতৃত্বে গত রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে পেশাজীবী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশকে ঘিরে চলছে নানা আলোচনা। ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির’ দাবিতে এ সমাবেশ থেকে সরকার পতনের ডাক দেন নেতারা। এ দাবিতে শিগগিরই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানান তারা। শওকত মাহমুদ এই সমাবেশের নেতৃত্ব দিলেও এতে উপস্থিত ছিলেন না বিএনপির তেমন কোনো নেতাকর্মী। ওই সমাবেশে যেতে বিএনপি পক্ষ থেকে দলের নেতাকর্মীদের বারণ করা হয়েছিল বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সমাবেশের মূল উদ্যোক্তা শওকত মাহমুদ বিএনপিপন্থি পেশাজীবীদের সংগঠন বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক। আর সদস্য সচিব ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন। কিন্তু তিনি উপস্থিত না থাকলেও লে. জেনারেল (অব.) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী, যুবদলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এলবার্ট ডি কস্তাসহ পেশাজীবী দলের বেশ কয়েকজন নেতাকে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেছে।
এ বিষয়ে বিএনপি নেতারা বলেন, ওই সমাবেশের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। এমনকি এই কর্মসূচির সম্পর্কে আগে থেকেও কোনো কিছু জানতো না বিএনপি।
তবে এই সমাবেশকে ঘিরে কোনো ষড়যন্ত্র বা কোন্দল নয় জানিয়ে- শওকত মাহমুদ বলেন, আমি এ বিষয়ে আপাতত কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। দুই-একদিন পরে এ নিয়ে কথা বলবো। সংবাদ উৎসঃ মানবজমিন