কখনো কি মনে হয় ক্লান্তি লাগে। ভালো লাগে না। আর কাজ করবো না। গান-বাজনা বাদ দিয়ে একেবারে অবসর থাকবো। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াবো। এমনটি কি কখনো মনে হয় আপনার?
কবীর সুমন: আমি তিয়াত্তর বছর পেরিয়ে যাওয়া একজন মানুষ, যে অনেক দীর্ঘ পথ হেঁটেছে জীবনে। আমার চেয়েও বেশি পথ হেঁটেছে অনেকেই। কিন্তু তুলনা করা যায় না মানুষে মানুষে। জিজ্ঞেস করেছেন, ক্লান্তি লাগে কিনা। হ্যাঁ, ক্লান্তি লাগে। কিন্তু কী করবো! গান নিয়ে আর থাকতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে কি জানেন? ইচ্ছে করে অন্য কোথাও চলে যাই, যেখানে গাছপালা, পুকুর ও সাধারণ মানুষ দেখতে পাবো। হিন্দু, মুসলমান, কমিউনিস্ট, নাস্তিকÑএ ধরনের বাঙালিকে এড়িয়ে রাস্তঘাটে সবুজ অরণ্য, পশুপাখি, মাঠে গরু, ছাগল চড়ছে দেখে দেখে যদি সময়টা আরেকটু কাটাতে পারতাম, ভালো লাগতো। আর ভালো লাগছে না পশ্চিমবঙ্গে।
আপনার কি কোনো প্ল্যান আছে, সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটাবেন? বাংলাদেশে আপনার অনেক ভক্ত ও শুভাকাক্সক্ষী আছেন। আপনিও বাংলাদেশকে পছন্দ করেন। আসবেন কি বাংলাদেশে?
কবীর সুমন: মাফ করবেন আমাকে! বাংলাদেশে আসতে চাই না। কারণ আমি যখন আমেরিকায় ছিলাম, ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগে কাজ করতাম। সেখানে আমার ঘনিষ্ঠতম বহু বন্ধু ছিলেন। আব্দুল্লাহ আল ফারুক তাদের মধ্যে অন্যতম। ফারুকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিলো ১৯৭৬ সালে জার্মানিতে। ভয়েস অব জার্মানিতে ছিলেন তিনি, আমি ছিলাম ফ্রিল্যান্সার। ওখানে আমাদের বন্ধুত্ব হয়। আমি প্রথমে আমেরিকায় চাকরি নিয়ে চলে যাই, ভয়েস অব আমেরিকায়। তারপর ফারুক সেখানে আসেন। ফারুক আমার জীবনের অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িত। আমি যখন কলকাতায় ফিরে আসি, ফারুক আমাকে বলেছিলেন, সুমন শোন, তুই না কলকাতায় যাস না। তুই এখানে থেকে বাংলা গান তৈরি কর। তাতে তুই তোর দেশে কদর পাবি বেশি। সমর সেন, বিখ্যাত কবি ও সাংবাদিকÑতিনিও আমাকে বলেছিলেন যে দেশে, যে সমাজে ফেরার জন্য আপনি এতো ব্যাকুল সেখানে আপনার মতো লোকের কোনো প্রয়োজন নেই। এটা বুঝতে শিখুন। আপনি আমেরিকাতেই থেকে যান। তাতে আপনার মঙ্গল, পৃথিবীরও মঙ্গল! আমি যদি তাদের দুজনের কথা শুনতাম, আমার জীবনটা এতো দুবির্ষহ হতো না।
আমার কপালে কোনোদিন নোবেল পুরস্কার জুটবে না! এই পরিস্থিতি আমার হতো না, যদি আমেরিকায় থেকে বাংলা গান তৈরি করতাম। কাজেই আমার বাংলাদেশে না যাওয়াই ভালো। বাংলাদেশের কিছু মানুষ এখন আমাকে ভালোবাসেন, সেটা আমি যে মুহূর্তে আমি বাংলাদেশে যাবো (স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করা), তারপর আর ভালোবাসবেন না।
তাহলে কি আমেরিকা থেকে কলকাতায় ফিরে আসাটা ভুল ছিলো?
কবীর সুমন: সম্পূর্ণ ভুল ছিলো কলকাতায় ফিরে আসা। আমি কলকাতায় ফিরে যে কাজটা করতে পারলাম, ইন্ডাস্ট্রিয়ালি করতে লাগলাম। অর্থাৎ সংগীত ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকলাম, তখন একটা বিশাল জায়গা খুলে গেলো বাংলা আধুনিক গানের জন্য। এতে স্বাভাবিকভাবেই সংগীত ইন্ডাস্ট্রিতে নানান মানুষ আসতে লাগলেন। তাদের অধিকাংশেরই কোনো প্রস্তুতি ছিলো না। কিন্তু আমার ছিলো। আমি দীর্ঘদিন ধরে এ কাজটি করেছি। আমি ১৯৬৭ সাল থেকে আকাশবাণী কলকাতার আধুনিক ও রবীন্দ্রসংগীতে মোটামুটি উচ্চশ্রেণির একজন গায়ক ছিলাম আমি। আমার তখন ১৯ বছর বয়স। যে শ্রেণিতে তখন বড় বড় গায়কও ছিলেন। প্রথমে আমি কয়েকটি আধুনিক গান গাই, তারপর আমাকে আধুনিক গানে সুর দিতে হয়েছে। আমি তখন গান লিখতাম না। লেখকেরা আমাকে লিরিক দিতেন, আমি তাতে সুর দিতাম। আধুনিক গানের সুর করার অভিজ্ঞতা আমার অল্প বয়স থেকেই ছিলো। আমি গান লেখা শুরু করি ১৯৭৫ সাল থেকে।
আধুনিক গানের জন্য কি আপনার কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিলো?
কবীর সুমন: আধুনিক গানের জন্য আমার দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিলো। আর আমার স্বরচিত প্রথম আধুনিক গানের অ্যালবাম, ‘তোমাকে চাই’ বের হয়েছিলো ১৯৯২ সালে। সে সময় ভারতের মাক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআইএম) চেষ্টা করেছিলো আমাকে তাদের সম্পত্তি বানাতে। পারেনি। আমি লড়ে গিয়েছিলাম একা। তাদের কারও সম্পত্তি হইনি আমি। কারণ আমি তো লোকের কাছে পৌঁছে গেছি। কিন্তু আমি তো সিপিআইএম’র কাছে ধরা দিতে চাই না। কমিউনিস্ট নেতাদের বললাম, ভাই আপনাদের যদি ভালো লাগে, আমার গান শুনুন। আমাকে ভাড়া করুন। আমি তো পেশাদার একজন গায়ক। কিন্তু তারা সেটা চাইলেন না। চাইলেন আমাকে ভোগদখল করতে! এটা তাদের স্বভাব। রাজি করাতে না পেরে তারা আমার নামে গালাগাল দিতে শুরু করলেন এবং তারা তাদের একজন শিল্পীকে দাঁড় করালেন। এই যে আমার ওপর আক্রমণ শুরু হলো, যদি আমেরিকায় থেকে যেতাম, তা হতো না। কারণ আমি বহুদূরে আছি। বরং লোকে প্রায় ঈশ^রের প্রসাদ পাওয়ার মতো দুটো হাত তুলে বলতেন, ‘আহাÑআহা! কবীর সুমন কতো ভালো’, কী ভালো গান গান’ , কী ভালো ভালো কথা বলেন!
দীর্ঘ সংগীত জীবনের প্রাপ্তি কী বলে মনে করেন আপনি। কোনো অপ্রাপ্তি আছে কি?
কবীর সুমন: পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারত আমাকে বিন্দুমাত্র মূল্যায়ন করেনি। তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই। কারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও একজন সংগীতকার হিসেবে কোনো মূল্যায়ন হয়নি। কাজী নজরুল ইসলামেরও সংগীতকার হিসেবে কোনো মূল্যায়ন হয়নি। সংগীতকার হিসেবে আমারও কোনো মূল্যায়ন হয়নি এটাই আমার বড় প্রাপ্তি! এটাকে আমি প্রাপ্তিই বলবো! অনেক লোকে আমার গান শুনে তো। আমার গান শোনাই উচিত। আমি তো ইয়ার্কি মারছি না। আমার গান যদি শোনার মতো না হতো, বাংলাদেশের গানের যুবরাজখ্যাত আসিফ আকবর কি আমার কাছ থেকে গান নিতেন? নিতে চাইতেন? লাখ লাখ লোক শুনতেন আমার লেখা গান? বাংলাদেশে আমার একজন নবীন বন্ধু আছেন, মীর আরিফ বিল্লাহ। তিনিই আসিফ আকবর মহোদয়ের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে। আমার লেখা ও সুর করা গান আসিফ আকবর গাইলেন। গান রিলিজের পর লোকে তা শুনে কী কী মতামত দিচ্ছিলেন, সেগুলো ফরোয়ার্ড করে আরিফ আমাকে জানাতেন। তাতে আমি জানতে পারি, কীভাবে আমার লেখা ও সুর করা গান বাংলাদেশের মানুষ শুনছেন। আমি তো তাদের পয়সা দিই না। টাকা দিয়ে তাদের মতামত কিনি না। তাদের ভালো লাগছে কেন? নিশ্চয়ই কিছু পারি বলে।
বাংলাদেশের কোন ব্যাপারটা আপনার ভালো লাগে, কিংবা কোনো খারাপ লাগা আছে কি?
কবীর সুমন: বাংলাদেশের খারাপ লাগার মতো কিছু দেখিনি এখনো পর্যন্ত। খুব ভালো লাগে বাংলাদেশের মানুষকে। কারণ অদ্ভুত একটা আন্তরিকতা আছে তাদের মধ্যে। যা অনেক জায়গায় পাইনি। রাস্তাঘাটের খুব সাধারণ মানুষটিও ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে আসেন, কথা বলেন। একটা উদাহরণ দিই। ১৯৯৮-১৯৯৯ সালের কথা। কলকাতা থেকে বিমানে ঢাকা যাই। বিমানবন্দরে নামি। ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনে অন্তত ১০-১৫ জন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। ঢাকার ইমিগ্রেশন অফিসার হাত তুলে আমাকে ডাকলেন। বললেন, ‘দাদা, আপনি সামনে আসুন। আপনি হলেন পাক-ভারত উপমহাদেশের সুমন।’ আমি বললাম, ‘আমার সামনে তো লোকজন রয়েছেন।’ তিনি বললেন, ‘না, আপনি সামনে চলে আসুন’। লাইনে যারা দাঁড়িয়েছিলেন সকলেই বাংলাদেশের নাগরিক। তাদের প্রত্যেকেই বললেন, ‘না না দাদা, পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবেন না, আপনি সামনে যান’। এমনটি আমার নিজের দেশ ভারতে জীবনেও কেউ করেননি। আমি যখনই ঢাকায় গিয়েছি তখনই একটা হাসিমুখ আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছে। সেই হাসি মুখটি একজন ইমিগ্রেশন অফিসারের। ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছ থেকে কাস্টমস অফিসারের কাছে গেলে তিনি বললেন, ‘আমি চাই আপনি বাংলাদেশে ঢুকবেন। আপনার লাগেজ চেক করার কিছু নেই’!
আপনি কি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চান? অথবা বাংলাদেশ যদি আপনাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেয়, গ্রহণ করবেন?
কবীর সুমন: কী আশ্চর্য! কেন গ্রহণ করবো না? অবশ্যই গ্রহণ করবো। বাংলাদেশ আমাকে নাগরিকত্ব দিলে খুব ভালো লাগবে। আমার বলতে ভালো লাগছে, গর্বও হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আমি যেমন গান করেছি দুই বাংলা মিলিয়ে, আর ক’জন করেছেন ‘এক আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…’ ছাড়া। খালাম্মা কবি সুফিয়া কামালকে নিয়ে বাংলাদেশে কেউ কোনো গান রচনা করেছেন কি? যে গান অনেকেই গাইতে পারেন, এমন কোনো গান কি গেয়েছেন কেউ? আমি কিন্তু শুনিনি। ভারতেও কেউ লেখেননি, বাংলাদেশেও তৈরি হয়নি কোনো গান খালাম্মাকে নিয়ে। গানের মতো গান। আমি কিন্তু খালাম্মাকে নিয়ে গান করেছি। ফলে বাংলাদেশ যদি কখনো কোনো সম্মান দেয় এবং সেখানে যদি কোনো রাজনৈতিক ব্যাপার জড়িত না থাকে, তাহলে আমি সম্মানিত বোধ করবো।
বাংলাদেশের শিল্পীদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক সম্পর্কে জানতে চাই। কারও সঙ্গে কি যোগাযোগ হয়, আসিফ আকবরের বাইরে?
কবীর সুমন: আমি খুব বেশি অতীতে যেতে চাই না। তবে বিগত ১১ বছরে আসিফ আকবর ছাড়া আর কোনো সংগীতশিল্পীর সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ হয়নি। তার আগে অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ ছিলো। এর মধ্যে কেউ কেউ মারাও গেছেন। তবে আরমান সিদ্দিকী নামে একজন গায়ক আছেন বাংলাদেশে, চমৎকার মানুষ। সম্ভবত আসিফের জন্য তৈরি গান শুনে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘দাদা আপনি কি আমার জন্য একটা গান তৈরি করবেন?’ আমি বললাম, ‘অবশই।’ পরিশ্রমের গলাকাটা মূল্য আমি চাই না। তবে যতোটুকু চেয়েছি, তিনি দিয়েছেন। আমি একটা গান লিখে সুর করে পাঠিয়ে দিই তাঁকে। বাংলাদেশে তিনি গানটি রেকর্ড করেন। আরমান সিদ্দিকী কলকাতায়ও এসেছিলেন, আমার সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। খুব ভালো লেগেছিলো। এর বাইরে এমামুল হক নামের একজনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিলো। তিনি গায়ক নন। একটা গান লিখে পাঠিয়েছিলেন। সামান্য দুয়েকটি শব্দ এদিক ওদিক করে গেয়েছিলাম আমি। এছাড়া আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ হয় না।