ত্রিপুরা নিউজ ডেস্ক: ত্রিপুরায় মুখ্যমন্ত্রী বদলের প্রায় তিন দিন কেটে গেলেও কৌতুহল যেন শেষ হতে চাইছে না। বরং আচমকা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত এই পরিবর্তন জন্ম দিচ্ছে নানা নতুন নতুন প্রশ্নের, যে গুলি এখন রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনেও ঘোরা ফেরা করছে। শাসক দলের নিচু স্তরের নেতাকর্মী, আমজনতা থেকে শুরু করে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সকলের কাছে একই প্রশ্ন কি সেই কারণ।
শাসক দলের তরফে বলার চেষ্টা করা হচ্ছে বিপ্লব কুমার দেবের সময় রাজ্যে সর্বোত্তম সুশাসন কায়েম হয়েছিল, তা এগিয়ে নেবের মানিক বাবু। দলকে আরো মজবুত অবস্থায় নিয়ে যাওয়া এবং ২০২৩ সালের নির্বাচনে যাতে দল জয়ী হতে পারে তার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে সরানো হয়েছে যাতে তাকে সাংগঠনিক দায়িত্বে দেওয়া যায়। এখানেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে, যে প্রশ্নগুলি দলীয় কর্মী থেকে শুরু করে বিরোধী শিবিরে ঘোরাফেরা করছে।
বিপ্লব কুমার দেব ২০১৬সালের শেষ দিকে প্রদেশ বিজেপি’র সভাপতির দায়িত্বে নিয়ে ষছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরও টানা দুই বছর সভাপতি ছিলেন। ২০২০সালে সভাপতি দায়িত্ব দেওয়া হয় ডা মানিক সাহাকে। বিপ্লব কুমার দেব যদি টানা দুই বছর দুটি পদে সমান দক্ষতার সঙ্গে সামলাতে পারেন তবে কি পরবর্তী ১০মাস সময় আবার মুখ্যমন্ত্রী ও সভাপতির দায়িত্ব সামলাতে পারতেন না? কারণ ২০২৩সালে মার্চে সরকারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে।
দলের উপরের স্তরের নেতৃত্ব থেকে শুরু করে মন্ত্রীদের দাবী এই সরকারের হাত ধরে রাজ্যে সুশাসন চলছে। তাই বিপ্লব কুমার দেবকে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেওয়া নিয়ে কোন প্রশ্ন করার অবকাশ নেই। সংগঠনকে আরো শক্তিশালী করার জন্য এখন তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী থেকে সরানো হয়েছে আবার সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হবে বলে কিছু কিছু নেতৃত্ব বলার চেষ্টা করছেন।
তবে কি ডা মানিক সাহা হাত সংগঠন সঠিক ভাবে পরিচালিত হচ্ছে না? এখন দলের সব চেয়ে ভাল সময় চলছে। ২০১৮ সালের আগে কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে সংগঠনকে, এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে টানা ২৫বছরের বাম সরকারকে গদিচ্যুত করতে সক্ষম হয়। তখন প্রায় প্রতিদিন দলের কর্মী সমর্থীদের উপর আক্রমণ হতো। দলের কর্মী খুনের ঘটনাও নিত্য দিনের অভিযোগ ছিল। এখন এমন পরিস্থিতি নেই।
বরং শাসক দলের বাইক বাহিনী প্রায় প্রতিদিন পুলিশের সামনে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিরোধী দলের কর্মী সমর্থকদের উপর আক্রমণ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে যদি সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ে তবে সভাপতি হিসেবে এর দায় ভার ডা মানিক সাহাকে নিতেই হবে। মানিক সাহা সভাপতি করা বিরোধিতা শুরুতেই রামপ্রাসাদ পালের মত দীর্ঘ দিনের এবং দলের সব চেয়ে কঠিন সময়ের নেতৃত্বরা করে এসেছেন, তবে তাদের কথা আবার সত্য বলে প্রমাণিত হল!
একজন ব্যর্থ সংগঠক যিনি একটি সাজানো দলকে যদি সঠিক দিশায় পরিচালিত না করতে পারেন, তবে কি করে রাজ্যকে সঠিক দিশায় নেবেন কি করে? এই প্রশ্নও উঁকি দিচ্ছে। তিপ্রমথার সুপ্রিমো প্রদ্যুৎ কিশোর রাজ্য জনজাতিরা বঞ্চিত, নতুন করে এই জিগির তোলেছেন বেশ কিছু দিন ধরে। তাঁর বক্তব্য জনজাতিদের সমস্যা জনজাতি নেতারাই বুঝবে এবং সমাধান করতে পারে। তারা প্রশ্ন অসমে অসমীয়া মানুষ মুখ্যমন্ত্রী হয়, একই ভাবে মিজোরামে মিজো, মেঘালয়ে গারো হতে পারে তবে ত্রিপুরায় কেন তিপ্রাসা থেকে মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন না?
এই জিগির তুলে তিনি রাজনৈতিক ভাবে অনেকটাই সফল হয়েছেন বলে দাবী রাজনৈতিক স্বচেতন মহলের। কারণ জনজাতিদের থানসা অর্থাৎ জনজাতি ঐক্যের কথা বলে ত্রিপুরা উপজাতি স্বশাসিত জেলা পরিষদের ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়েছেন। এখন প্রদ্যুৎ কিশোরের লক্ষ্য তার এই স্লোগানকে হাতিয়ার করে ২০২৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের জনজাতি সংরক্ষিত ২০টি আসন তার দলের কুক্ষিগত করা ও পরবর্তী সরকার গঠনের নির্ণায়ক ভূমিকা নেওয়ার। এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী দায়িত্ব যদি উপমুখ্যমন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মণকে দেওয়া হতো তবে দলের নেতা-কর্মী যারা মানিক সাহাকে নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তারা চুপ হয়ে যেতেন। তেমনি প্রদ্যুৎ কিশোরের অভিযোগের জবাবও দিয়ে দেওয়া যেতো, যে বিজেপিও জনজাতিদের মুখ্যমন্ত্রী করেছে।
সর্বোপরি যে প্রশ্নটি উঠছে সেটি হল বিপ্লব কুমার দেবের হাত ধরে রাজ্যের যে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে তার পুরোটাই প্রায় স্বঘোষিত। তিনি নিজেই নিজেকে অনন্য উচ্চতায় তোলে ধরার চেষ্টা করেছেন সব সময়। এই সাফল্যের কৃতিত্ব আগের কাউকে তো দূর নিজদলের কাউকেই দিতে চাননি। যা করেছেন সব নিজে, আগে কেউ কিছু করতে পারেনি, ভবিষ্যতে কেউ পারবে বলেও মনে হচ্ছে না, এমন ভাব দেখাতেন। আর তার আশেপাশে থাকা কিছু লোক এবং কিছু সংবাদ মাধ্যম তাকে নিয়ে অন্ধের মত গুনকীর্তন করেছে। এই বিষয় গুলি নিয়ে মুখে কেউ কিছু না বললেও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি বেশীর ভাগ মানুষ। ফলে এরা প্রকাশ্যে না বললেও ভেতর থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছিলেন। তার এই সব কাজের খবর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে যাওয়ার প্রেক্ষিতে তারা নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে মুখ্যমন্ত্রী বদলের সিদ্ধান্ত নেন। যাতে করে তাকে পরিবর্তন করার সুযোগ দেওয়া যায়। নিজেকে পরিবর্তন করতে পারলে এবং দল জয়ী হলে ২০২৩আবার মুখ্যমন্ত্রীর পদে দেখা যাবে বলেও অভিমত অনেকের। তবে আগামী দিনে কি হয় তা দেখার জন্য আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন বিকল্প কোন পথ নেই।