হাবিবুর রহমান, ঢাকা: বাংলাদেশের সিলেটসহ অন্যান্য কিছু জেলায় বন্যা পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। অবিরাম বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। বন্যার জলের কারণে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার লাখ লাখ মানুষ জলবন্দি হয়ে পড়েছেন। তলিয়ে গেছে শত শত গ্রাম। পানিতে ঘরের চালা স্পর্শ করেছে। ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় মানুষজন বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিচ্ছেন। আটকাপড়াদের উদ্ধারে অভিযানে যোগ দিয়েছে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী।
বন্যার জল নগরের অনেক উঁচু এলাকা প্লাবিত হয়ে শত বছরের রেকর্ড ভেঙেছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বন্যাকবলিত মানুষকে বাঁচাতে উদ্ধার তৎপরতা বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন বানভাসিরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেট, সুনামগঞ্জের নিমজ্জিত এলাকাগুলো থেকে বন্যাদুর্গত মানুষদের উদ্ধার করতে সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী, ডুবুরি পৌঁছেছে সিলেটে। বন্যাকবলিত মানুষকে বাঁচাতে নৌযান ও হেলিকপ্টারের মাধ্যমে উদ্ধার অভিযান চালানো হচ্ছে। উদ্ধার কাজের জন্য নৌ বাহিনীর ৩৫ জনের একটি ডুবুরি দল কাজ শুরু করেছে। গতকাল বিকেলে ৬০ জনের আরেকটি বড় দল উদ্ধার অভিযানে যুক্ত হয়েছে। তবে বৈরি আবহাওয়া ও সেক্ষেত্রে উদ্ধার কাজ কতটুকু সফল হবে তা নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
এদিকে সিলেটের উপশহর, চৌহাট্টা, আম্বরখানা, দক্ষিণ সুরমা, হাউজিং এস্টেট, জিন্দাবাজার, কদমতলী, বাস স্টেশন, রেলস্টেশনসহ শহরের ৮০ শতাংশ এলাকা জলের নিচে তলিয়ে গেছে। এতে জলের তীব্রতা আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করায় জীবন নিয়ে শঙ্কিত সিলেটের মানুষরা। এ পরিস্থিতিতে ত্রাণ না দিয়ে প্রাণে বাঁচানোর আকুতি জানাচ্ছেন বন্যাকবলিত মানুষেরা।
তবে তাদের সে আকুতি শুনবে কে? অনেকে বাসাবাড়িতে মালামাল রেখেই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। বৈরি আবহাওয়ার মধ্যেও মানুষ স্বজনদের নিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে অন্যত্র যাচ্ছেন।এদিকে সিলেটের রেলস্টেশন বন্যার জলে ডুবে যাওয়ায় শনিবার সকাল থেকে সারাদেশের সঙ্গে সরাসরি সিলেটের বাস ও রেল যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে সিলেটের রেলস্টেশন মাইজগাঁও থেকে ট্রেন চলাচল অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট রেলস্টেশনের ম্যানেজার নুরুল ইসলাম।
স্টেশন ম্যানেজার নুরুল ইসলাম আরো বলেন, পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টির কারণে রেললাইন তলিয়ে যাওয়ায় সিলেট রেলওয়ে স্টেশন আপাতত বন্ধ থাকবে। ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে এখন সরাসরি সিলেট স্টেশনে কোনো ট্রেন আসবে না। গতকাল শনিবার সকালে সিলেট স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে ‘কালনী এক্সপ্রেস’ এবং ‘জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস’ ট্রেন ছেড়ে গেছে। এখন ট্রেন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও স্টেশন এবং মৌলভীবাজারের কুলাউড়া স্টেশন থেকে চলাচল করবে। এর আগে বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় সিলেট বিমানবন্দরও। যে কারণে বিমান ওঠা-নামা বন্ধ রয়েছে।অপরদিকে, গত পাঁচ দিন ধরে সুনামগঞ্জ, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট জকিগঞ্জ, সিলেট সদর দক্ষিণ সুরমাসহ সবকটি এলাকা প্লাবিত হয়ে জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।
গত কয়েকদিন ধরে বিদ্যুৎহীন থাকায় এসব এলাকার কোনো খবরও পাওয়া যাচ্ছে না। এরই মধ্যে সিলেটের সুরমা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় নগরের কুমারগাঁও ১৩২/৩৩ উপ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা বিদ্যুৎহীন রয়েছে।
বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল কাদের বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রে পানি ওঠায় আপাতত সাব স্টেশনটি বন্ধ করা হয়েছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি জল সেচে দ্রুত সময়ের মধ্যে এটি আবার চালু করতে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে সিলেটের প্রায় সব সাব স্টেশনে পানি উঠতে শুরু করে। গত শুক্রবার দুপুর থেকে কুমারগাঁও ১৩২/৩৩ উপ বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল রাখতে যৌথভাবে কাজ শুরু করে সেনাবাহিনী, বিদ্যুৎ বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশন।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারপাশে বাঁধ নির্মাণ করেও জল আটকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে আগের তুলনায় কয়েকগুণ পানি বেড়েছে বিদ্যুৎ গ্রিডে। পানি বাড়তে থাকায় বিদ্যুৎতের উপকেন্দ্রটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।সুবিদবাজার এলাকার বাসিন্দা আবুল খায়ের বলেন, এত প্রবল স্রোতে জল প্রবেশ করতে এর আগে কখনো দেখিনি। এসব জল হয়ত পাহাড়ি ঢলের কারণে আশপাশের উপজেলা তলিয়ে নগরীতে প্রবেশ করছে।
ঘণ্টাখানেক সময়ের মধ্যে বিভিন্ন রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। নগরের ড্রেন-রাস্তা উপচে জল প্রবেশ করছে বাড়িঘরে। এতে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে স্থানীয় সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে।নগরীর দরগা মহল্লা এলাকায় জাফরান নামে একটি রেস্টুরেন্টে কর্মরত জাফর আলী বলেন, এই এলাকায় সাারণত বন্যার জল প্রবেশ করে না। গতকাল শনিবার সকাল ৯টা থেকে অবিরাম ভারী বর্ষণে রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। জল আরো বাড়লে হোটেলেও প্রবেশ করবে। সব মিলিয়ে খুব খারাপ অবস্থা যাচ্ছে।
নগরের বাগবাড়ির বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন বলেন, এত ভয়াবহ পরিস্থিতি আমি এর আগে কখনো দেখিনি। বন্যা হয়ে জল বেড়েছে কিন্তু এরকম উজানি ঢল আর একইসঙ্গে এত বৃষ্টিপাত দেখিনি।সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যৈষ্ঠ এক আবহাওয়াবিদ জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল এক ১০৮.৭ মিলিমিটার। সেখানে গতকাল সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ১৫৭ মিলিমিটার। এর মধ্যে সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ছিল ৪৭ মিলিমিটার এবং সকাল ৯টা থেকে দুুপুর ১২টা পর্যন্ত ছিল ১১০ মিলিমিটার। গতকাল আরো বৃষ্টি হয়েছে এবং এই অবস্থা আরও ২-৩ দিন অব্যাহত থাকবে।
এদিকে, সিলেট ও সুনামগঞ্জ বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন বন্যা কবলিত এলাকার মানুষের স্বজনরা। মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় খোঁজও রাখতে পারছেন না। স্বজনরা প্রতিটি মুহূর্ত উদ্বেগের মধ্যে কাটাচ্ছেন। তবে যে যেভাবে পারছে বন্যার কবলে পড়া মানুষজনের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্যায় ক্ষতি-গ্রস্ত মানুষের বাড়িঘর, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ-মাদ্রাসা, হাসপাতালসহ নানান প্রতিষ্ঠানের ছবি পোস্ট করছেন। তাদেরই একজন জসিম রুপু। চাকুরি করেন ব্রাক ব্যাংকে সিলেট শাখায়। নিজের পরিবারের সদস্যদের উদ্ধারে আকুতি জানিয়ে গতকাল শনিবার বেলা ১০টায় ফেসবুকে লিখেছেন-ইয়া, আল্লাহ! স্ত্রী সন্তানের আহাজারি, দুই দিন যাবত যোগাযোগ বন্ধ।
ঢাকার একটি গণমাধ্যমের ভিডিও এডিটর রাসেল আহমদ লিখেছেন, পরিবারের কারো সাথেই যোগাযোগ করতে পারছি না। সবার ফোন বন্ধ পাচ্ছি। আশীষ রহমান লিখেছেন, আমার এলাকা সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার অনেক এলাকার মানুষ তিনদিন ধরে পানিবন্দী অবস্থায় আছে। না খেয়ে আছে। নিদ্রাহীন আছে। তাদের সাথে এখন কারোরই যোগাযোগ নেই। বেঁচে আছে কি-না মারা গেছে তাও জানতে পারছিনা। কারেন্ট নাই। নেটওয়ার্ক নাই। এখন দরকার দ্রুত নৌকা নিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদেরকে জরুরি উদ্ধার করা, খাবারের ব্যবস্থা করা, বিশুদ্ধ খাবার জল ও ঔষুধের ব্যবস্থা করা। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তা করা হচ্ছে না। যেটুকু করা হয়েছে বা হচ্ছে তা অপ্রতুল, অপর্যাপ্ত। ফেসবুক, মিডিয়ায় যা দেখা যাচ্ছে বাস্তবে তারচয়েও খারাপ! প্লিজ প্রতিটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে গ্রামে গ্রামে স্পিডবোট/ নৌকাসহ নৌবাহিনী সদস্যদের পাঠান। উদ্ধার জরুরি। সিলেটের একটি ফেসবুক গ্রুপে শেখ রুবেল লিখেছেন, ছাতকের জাউয়া বাজার এলাকায় একটা পরিবারকে বাচাতে একটা ইঞ্জিন নৌকা অতীব জরুরি। যতো টাকা লাগে সমস্যা নাই, যদি কেউ সন্ধান দিয়ে একটু সাহায্য করতে পারেন।
একইদিন বিকেলে সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী লিখেছেন, সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে বহু পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছেন। সবাই নেটওয়ার্ক যোগাযোগের বাহিরে। ওখানে কি ঘটনা ঘটতেছে একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। জরুরী উদ্ধার প্রয়োজন। সাংবাদিক রাফিদ চৌধুরী গতকাল বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লিখেন, সিলেট নগরের সবচেয়ে উঁচু এলাকায় থাকি। এদিকে সাধারণত বানের পানি রাস্তা উঠারও শঙ্কা নেই। কিন্তু এই বন্যার কবল থেকে আমার বাড়িটিও রক্ষা পায়নি। সকাল ১০টার পর মুহূর্তের মধ্যেই পানিতে ভেসে যায় পাড়ার রাস্তা। সিলেট এমসি কলেজ শিক্ষার্থী আহমেদ শিহাব খান লিখেছেন, বন্যার অবস্থা খুবই ভয়াবহ আঁকার ধারণ করেছে। এখন তো একজন আরেকজনের বিপদে কিছুটা হলেও খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু বন্যার পরিস্থিতি আরো বেশি অস্বাভাবিক হলে, সামনের দিনগুলিতে কেউ কারো পাশে দাঁড়াতে পারবে কি-না একমাত্র আল্লাহ ভালো জানেন।
এদিকে বন্যায় বিপর্যস্ত সিলেট নগরীতে জল বেড়ে যাওয়ায় নগরের অভ্যন্তরেও প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গাড়ি চলাচল। এমনকি লাশ বহন করার জন্যও পাওয়া যাচ্ছে না এ্যাম্বুলেন্স। তাপস সূত্রধর লিখেছেন-মারা গেল কে তা জানা নেই। লাশ নেয়ার জন্য গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না জলের জন্য। জলের উপর দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়জনরা লাশ নেয়ার অপেক্ষায়…। বন্যার জলের কারণে শনিবার সিলেটের রেলস্টেশন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে করে সারা দেশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সিলেটের রেল যোগাযোগ।
গতকাল শনিবার ভোরের কাগজ পত্রিকার জেষ্ঠ্য প্রতিবেদক ঝরনা মনি আক্ষেপ করে লিখেছেন, রোম যখন পুড়ছিল, নীরু তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল! বৃহত্তর সিলেটবাসী একটু আশ্রয়ের জন্য হাহাকার করছে। ৫০ লাখ জলবন্দি। খাবার নেই, খাবার পানি নেই, পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্রে নেই। বিদ্যুৎ নেই, সারা দেশ থেকে সিলেট এক বিচ্ছিন্ন জনপদ। আর এই সময়ে রাজধানীতে ভোট উৎসব ও ভুরিভোজ করে সিলেটের জালালাবাদ এসোসিয়েশন! বাহ্! চমৎকার। গত শুক্রবার বিকেলে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সব ধরনের বিমান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়।