বাংলাদেশ নিউজ ডেস্ক: ‘মায়ের ডাক’ এর আয়োজনে শনিবার মানববন্ধনে উপস্থিত হয়েছিলেন গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা
“আমি আমার বাবাকে ফেরত চাই। তিনি মারা গেলে তার লাশ চাই। না হলে আমাদেরকেও আয়না ঘরে নিয়ে যান। আমি আমার বাবাকে দেখতে চাই”।
গুম হওয়া ছাত্রদল নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের সন্ধান চেয়ে এভাবেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তার বড় মেয়ে।
বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর গুম করা ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এর আয়োজনে শনিবার (২০ আগস্ট) মানববন্ধনে উপস্থিত হয়েছিলেন গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা। উপস্থিত আপনজনরা কেউ বাবাকে, কেউ স্বামী ও কেউ সন্তানকে ফেরত চেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তাদের কান্না দেখে অনেককেই নীরবে চোখের পানি মুছতে দেখা গেছে।
ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার সরকার গত এক যুগে বিএনপি সহ ভিন্ন মতের প্রায় ৬শতাধিক ব্যক্তিকে গুম করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ, র্যাব অথবা রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা আটকের পর গুম করা ব্যক্তিরে বেশ কয়েকজনের লাশ পাওয়া গেলেও বেশিরভাগের সন্ধান মেলেনি।
সম্প্রতি সুইডেনভিত্তিক নেত্রনিউজের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই এর গোপন কারাগার “আয়নাঘর” এর ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরার পর গুম হওয়া স্বজনদের ধারণা তাদের প্রিয়জনকেও সেখানেই আটক করে রাখা হয়েছে।
গুমর শিকার কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেনের স্ত্রী নিশা হোসেন তার স্বামীর গুমের বর্ণনা দিয়ে বলেন, আমার স্বামীকে গুমের পর আমি আমি র্যাব-৪-এ যাই। তারা বলে এটা পুলিশের বিষয়। পুলিশের কাছে যাওয়ার পর তারা বলে র্যাবে যান। ১ বছরের ছেলে ও ১৩ বছরের মেয়েকে নিয়ে পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। ডিবি অফিস থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সব জায়গায় গিয়েছি।
তিনি বলেন, আজ আমি এখানে কাঁদতে আসি নাই। কাঁদতে কাঁদতে চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। আমি আর কাঁদব না। বিচার চাইবো। মেজর নাঈম আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁকে ধরলেই আমার স্বামীকে পাওয়া যাবে।
স্বামীর সন্ধান চেয়ে তিনি বলেন, “আমাদেরকে আয়না ঘরে নিয়ে যান। আমরা আয়নাঘরের সন্ধান চাই। আমাদেরকেও সেখানে নিয়ে যান। আমি আমার স্বামীর কষ্ট ভাগ করে নিতে চাই। আমার স্বামীর সাথে আমি আয়না ঘরে বন্দি থাকতে চাই। আমরা এমন জীবন্ত লাশ হয়ে থাকতে চাই না।”
মানববন্ধনে সংহতি প্রকাশ করে নাগরিক ঐক্যের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “শুধু ডিজিএফআইয়ের আয়না ঘরে দেখলেন? এনএসআই, ডিবি, র্যাবের গোপন কারাগার দেখেন নি? আমি সবার দেখি নাই। শুধু ডিবির দেখেছি। তাও সবগুলো ঘর দেখি নাই। একটা-দুইটা দেখেছি।”
কারাবন্দী অবস্থার স্মৃতিচারণ করে তিনি আরও বলেন, “কাশিমপুর কারাগারের হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় আমি ভর্তি ছিলাম। তখন একজন বড় দাড়িওয়াল লোক এসে সালাম দিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কে? তিনি জবাবে বললেন, আমার ছবি আজকের পত্রিকায় দেখেন নি? আমি বললাম, আজকের পত্রিকা দেখি নাই। তখন তিনি বললেন, আমাকে জঙ্গি বলে ধরে আনা হয়েছে।
তিনি জানালেন, নো এন্ট্রি ঘর নামে এক ঘরে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল। সেখানে আমাদের মতো লোকদের দিনের পর দিন আটকে রাখা হয়। নখ কাটতে দেয় না। চুল কাটতে দেয় না। দরকার হলে জঙ্গি হিসেবে আনা হয়।
মান্না বলেন, শুধু আয়নাঘর নয়, যতো ঘর আছে সব ঘরের বন্দীদের লিস্ট প্রকাশ করতে হবে। এসব ঘরের অস্তিত্ব অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
মানববন্ধনে সংহতি প্রকাশ করে ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা সাবেক ভিপি নূর বলেন, এটা স্পষ্ট যে পুলিশ ডিবি তাদেরকে তুলে নিয়ে গেছে। এখন নাটক বানাচ্ছে যে তাদেরকে তুলে নিয়ে যায় নাই। সেনাবাহিনীর বিগ্রেডিয়ার থেকে সাধারণ অনেক মানুষ এখনও নিখোঁজ রয়েছে।
আয়নাঘরের প্রসঙ্গে তুলে তিনি বলেন, আমার ধারণা সব গুম হওয়া ব্যক্তি রাষ্ট্রের হেফাজতে রয়েছেন। মায়ের ডাক যদি ডাক দেয়, তবে কচুক্ষেতের আয়নাঘরে ঘেরাও করা হবে। আমরা দেখতে চায় কাদেরকে আয়নাঘরে বন্দি রাখা হয়েছে।
মানববন্ধনে সংহতি প্রকাশ করে এবি পার্টির ব্যারিস্টার ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, চল্লিশ বছর পর কাগজের মামলা দিয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতাদের জুডিশিয়াল হত্যা করা গেলে, এই বাংলাদেশে আল্লাহর কসম আপনাদেরও বিচার হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল বলেন, সরকারের কাছে যখন গুমের অভিযোগ করা হয়, সব সময় তারা অস্বীকার করে। তারা বলে এই ৬০০-৭০০ লোক তারা নাকি পালিয়ে গেছে। কিন্তু, দেশের ৯৫% শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করে আপনারাই গুম করেন। আপনারা যদি গুম না করেন তাহলে এটার সুরাহা কেন হচ্ছে না। সাহস থাকলে ভাল মানুষদের নিয়ে কমিটি করে তদন্ত করেন।
ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা রাশেদ খান বলেন, যাদেরকে গুম করা হয়েছে তাদেরকে হয়তো আয়না ঘরে রাখা হয়েছে। সুতরাং, জাতিসংঘের অধীনে নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে।

