একদিকে চীন অন্যদিকে ভারতকে রেখে কূটনীতির নতুন পথে হাঁটার বার্তা দিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আগামী দিনে ভারত এবং চীনের সঙ্গে যোগাযোগ আরও বাড়াবে রাশিয়া।
ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পশ্চিমাদের সঙ্গে বৈরি সম্পর্কের মধ্যেই ‘রুশ বিশ্ব’ দর্শনের ভিত্তিতে নতুন পররাষ্ট্র নীতি পরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের ছয় মাসেরও বেশি সময় পর পুতিনের ৩১ পৃষ্ঠা সংবলিত এই পররাষ্ট্রনীতি পরিকল্পনা প্রকাশিত হলো, যাকে বলা হচ্ছে ‘মানবহিতৈষী নীতি’। এতে বলা হয়েছে, রুশ বিশ্বের ঐতিহ্য ও আদর্শ এগিয়ে নেয়া এবং এর সুরক্ষা নিশ্চিতে কাজ করবে রাশিয়া।
অনেকে বলছেন, পুতিন পশ্চিমা বিশ্বের বদলে নতুন এক ‘রুশ বিশ্ব’ গড়তে চান। পুতিনের নতুন পররাষ্ট্রনীতি সেই ধারণার ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। এই রুশ বিশ্বের ধারণাটি মূলত রক্ষণশীল মতাদর্শীদের একটি ধারণা। এটি রুশভাষীদের সমর্থনে অন্য দেশের ওপর হস্তক্ষেপকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য রক্ষণশীলেরা ব্যবহার করে থাকেন। পররাষ্ট্রনীতিতে বলা হয়েছে, রুশ বিশ্বের ঐতিহ্য ও আদর্শ সুরক্ষার পাশাপাশি এর অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করবে রাশিয়া।
রাশিয়ার পক্ষ থেকে তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে মানবিক কৌশলের কথা বলা হলেও এতে মূলত রুশ রাজনীতি ও ধর্মীয় সরকারি নীতির ধারণাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু কট্টরপন্থী বিষয় যুক্ত হয়েছে, যাতে ইউক্রেনের কিছু অংশে মস্কোর দখলকে বৈধতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া বিচ্ছিন্ন রুশপন্থী সত্তাগুলোর প্রতি সমর্থনের বিষয়টিও যুক্ত করা হয়েছে।
রুশ পররাষ্ট্রনীতিতে আরও বলা হয়েছে, রুশ ফেডারেশন প্রবাসী রুশ নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় সমর্থন দেবে। তাঁদের স্বার্থরক্ষা ও রুশ সাংস্কৃতিক পরিচয় সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে তারা। প্রবাসী রুশ নাগরিকদের সঙ্গে সম্পর্ক আন্তর্জাতিক মঞ্চে রাশিয়াকে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে তুলে ধরবে এবং এর ভাবমূর্তিকে শক্তিশালী করবে।
পুতিন দীর্ঘদিন ধরেই রাশিয়ার বাইরে থাকা আড়াই কোটি রুশভাষী মানুষের দুর্ভোগের বিষয়টি নিয়ে কথা বলে আসছেন। তাঁর দৃষ্টিতে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে এই লোকজন ভাগ্যবিড়ম্বনার শিকার। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের এই পতনকে ভূরাজনৈতিক বিপর্যয় বলে মন্তব্য করেন।
গত সোমবার অনুমোদন পাওয়া এই নীতিতে স্লাভিক দেশগুলো, চীন ও ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা সম্প্রসারণের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া, ২০০৮ সালে জর্জিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের পর মস্কো থেকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়া আবখাজিয়া এবং ওশেটিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করাসহ পূর্ব ইউক্রেনে গণপ্রজাতন্ত্রী দোনেৎস্ক ও গণপ্রজাতন্ত্রী লুহানস্কের সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদার করা উচিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে পুতিনের নতুন এই পররাষ্ট্রনীতিতে।
অথচ গত ছয় দশক ধরেই সীমান্ত সমস্যা রয়েছে ভারত এবং চীনের মধ্যে। আবার গত কয়েক দশকে আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব বেড়েছে ভারতের! তবে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সোভিয়েতের উত্তরসূরি রাশিয়ার উপর ভারতের নির্ভরতাও রয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের পর প্রাথমিক ভাবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, সাধারণ সভা এবং মানবাধিকার পরিষদে রুশ হামলার বিরুদ্ধে আমেরিকা-সহ পশ্চিমা দুনিয়ার আনা একাধিক প্রস্তাবে ভোটদান থেকে বিরত থেকেছে নয়াদিল্লি। কিন্তু আগস্টে প্রথমবার রাশিয়ার হামলার নিন্দা করে জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদে আনা প্রস্তাব সমর্থন করেছে ভারত। এই পরিস্থিতিতে পুতিনের ঘোষণা ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারত এবং চীনের পাশাপাশি পুতিনের ওই নথিতে বলকান অঞ্চল, দক্ষিণ আমেরিকা, পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানোর কথা রয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে পৃথক ভাবে উল্লিখিত হয়েছে, ওশেটিয়া এবং আবখাজিয়ার প্রসঙ্গ। পূর্বতন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অন্তর্গত জর্জিয়ার ওই দুই অংশ রুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ।
পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলের (যাদের একত্রে ডনবাস বলা হয়) মতোই ওশেটিয়া এবং আবখাজিয়াতেও মস্কো-পন্থী সশস্ত্র মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো সক্রিয়। নব্বইয়ের দশকে জর্জিয়া সরকার তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করলে ক্রুদ্ধ রাশিয়া হানা দিয়েছিল জর্জিয়ায়। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের ঘোষণার আগে দোনেৎস্ক ও লুহানস্কে ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন পুতিন। প্রশ্ন উঠেছে, এবার কি তার নতুন ‘নিশানা’ হবে জর্জিয়া?