শিরোনাম
শুক্র. ডিসে ৫, ২০২৫

অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছে প্রায় এক লাখ বিদেশি নাগরিক

বাংলাদেশ নিউজ ডেস্ক: বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৯৭ হাজার ৬৯৫ নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। বছরের পর বছর ধরে তারা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দাবড়ে বেড়াচ্ছে। এদের কেউ কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। আবার কেউ অপহরণ, ছিনতাই, প্রতারণাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত। এসব অবৈধ বিদেশির কারণে সরকার প্রতি বছর সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। সম্প্রতি বিদেশি নাগরিকদের ভিসার শ্রেণিভিত্তিক অপব্যবহারের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি ও জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি পর্যালোচনা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, যেসব বিদেশি নাগরিক ভিসা ছাড়া বাংলাদেশে অবস্থান করছে তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। আমাদের কাছে তথ্য এসেছে, অনেকে নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তারা নবায়ন করছে না। ভিসা ছাড়া কোনো ভিনদেশিকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না। ইতিমধ্যে পুলিশকে বিশেষ নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।

পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিটের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, নানা কাজের কথা বলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে নানা বয়সী নারী-পুরুষ বাংলাদেশে আসে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আর নিজ দেশে ফিরে যায় না। তাদের মধ্যে আফ্রিকার নাগরিক বেশি। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তারা পাসপোর্ট ডাস্টবিনে ফেলে দেয় বলে আমাদের কাছে তথ্য এসেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ওইসব অবৈধ বিদেশির তালিকার কাজ শুরু হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিদেশি অপরাধীরা ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণ, প্রতারণাসহ নানা অপরাধে জড়িত। ইতিমধ্যে একাধিক বিদেশি অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। দেশের সব বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনকে সতর্ক করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিটি জেলার পুলিশ সুপারকে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অবৈধদের মধ্যে আফ্রিকার নাগরিকরা বেশি বেপরোয়া। তারাই বেশি প্রতারণা করছে।

প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ২১২টি দেশের ২ লাখ ১২ হাজার ৬৭ জন বিদেশি নাগরিক অবস্থান করছে, যা ২০২১ সালের তুলনায় চারগুণ বেশি। এসব বিদেশির যথাযথ শ্রেণির ভিসা না দেওয়ায় গমনাগমনের তৎপরতা বিগত বছরগুলোর তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশি নাগরিকরা বাংলাদেশে কী কাজ করছে তা নিরীক্ষণের আওতায় আনা দুরূহ হওয়ায় বিদেশিদের অবৈধ অবস্থান দেশের অর্থনীতিকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করছে। দেশে অবস্থানকারী বিদেশি অবৈধ নাগরিকের সংখ্যা ৯৭ হাজার ৬৯৫ জন। এদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যা ৬৮ হাজার ৩০৫ জন, চীনের রয়েছে ১৬ হাজার ২৩১ জন, ফিলিপাইনের ৯ হাজার ৯১৫ জন, নাইজেরিয়ার ২ হাজার ৬৮ জন, সোমালিয়ার ১ হাজার ১৫ জন, কেনিয়ার ৭৯ জন এবং ক্যামেরুনের ৮২ জন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ওয়ার্ক পারমিট বা অন-অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে আসছেন বিদেশিরা। তাদের মধ্যে কারও কারও ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও আর নবায়ন করছেন না। আবার কেউ কেউ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের অনুসন্ধানে কাজ করছে পুলিশ-র‌্যাব। যদিও কোনো অবৈধ বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে থাকতে পারবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অবৈধ বিদেশিরা উপহারের নামে প্রতারণা, হেরোইন, কোকেনসহ মাদক কারবার, ব্যাংকের এটিএম বুথের জালিয়াতি, বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রার কারবার, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, সোনা চোরাচালান, অনলাইনে ক্যাসিনো এবং মানব পাচারে জড়িয়ে পড়ছে। তারা নানা গ্রুপে ভাগ হয়ে অপরাধমূলক কর্মকা- চালাচ্ছে। নারীদের দিয়েও ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। তাছাড়া কাস্টমস কর্মকর্তা সেজে প্রতারণাও করছে। কেউ আবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে নানা কর্মকা- চালাচ্ছে। তারা মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ফেইসবুকসহ নানা মাধ্যম ব্যবহার করে নিজেদের পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করছে।

ভারত, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, আরব আমিরাত, ঘানা, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, মিসর, ব্রুনাই ও তুরস্কের নাগরিক আছে যাদের ভিসার মেয়াদ নেই তারা অন-অ্যারাইভাল ভিসা ব্যবহার করে বলে সূত্রটি জানায়।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী ভিসা নীতিমালা অনুযায়ী বাংলাদেশে ৩৭ ধরনের ভিসা শ্রেণি বিদ্যমান। এসব শ্রেণির মধ্যে বিজনেস (বি), এ৩, ট্যুরিস্ট (টি), স্টুডেন্ট (এস) ও ভিসা অন-অ্যারাইভাল (ভিওএ) গ্রহণকারী বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই চার ক্যাটাগরির ভিসাতেই ৫১ শতাংশ বিদেশি বাংলাদেশে অবস্থান করছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রযোজ্য শ্রেণির ভিসা না নিয়ে বিদেশিদের গমনাগমন অন্তরালে গুপ্তচর বৃত্তি, নাশকতামূলক কর্মকান্ডসহ জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত করার মতো কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে সংঘবদ্ধ বিদেশি নাগরিকদের একচেটিয়া ব্যবসা ও সিন্ডিকেট প্রক্রিয়া চালুর সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। একই সঙ্গে বিদেশিদের আইন অমান্য করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদেশিদের ৩০ শতাংশ হারে আয়কর প্রদানের বিধান থাকলেও উল্লিখিত চার ক্যাটাগরির ভিসার কারণে সরকার বছরে ৪ হাজার ৫৪১ কোটি ৮৩ লাখ ২০ টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়। ভিসা নীতিমালা পরিপন্থী কার্যক্রম এবং অবৈধভাবে শিল্পকারখানাসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করার সুযোগ পাওয়ায় বাংলাদেশিদের কাজের সুযোগ কমে যাচ্ছে এবং বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিভিন্ন দেশের বিপুলসংখ্যক বিদেশি নাগরিক সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ করার ফলে মাদক চোরাচালান, জনবিধ্বংসী সরঞ্জাম, অস্ত্র, গোলাবারুদ দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করাচ্ছে। একই সঙ্গে মানব পাচারের আশঙ্কা বৃদ্ধি করছে, যা দেশের যুবসমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। সোমালিয়ার বিপুলসংখ্যক নাগরিক স্টুডেন্ট ভিসায় এসে শিক্ষার আড়ালে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক তৈরি, স্থানীয় জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধি ও রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির গাইডলাইন দেওয়ার মতো হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে তারা।

পুলিশ সূত্র জানায়, এ-৩ শ্রেণির ভিসা নিয়ে বিশ্বের ৬০টি দেশের ৭ হাজার ৯৫০ জন বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে অবস্থান করছে। ৬৪ জেলার ২৭টিরও বেশি জেলায় বিভিন্ন প্রকল্পে ১০ হাজারের মতো বিদেশি কর্মরত আছে। তার মধ্যে ১ হাজার ৮০০ জন চীনা নাগরিক। কিন্তু বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি চীনা মেগা প্রকল্প চলমান রয়েছে। ফলে এ-৩ শ্রেণির চীনা ভিসাধারী নাগরিকের সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার কথা ছিল। এ-৩ শ্রেণির ভিসা নিয়েও ১ হাজার ৮০০ জনের মধ্যে ৪৫০ জন কোনো প্রকল্পে কর্মরত নেই বলে প্রশাসনের অভিযানে শনাক্ত হয়েছে। তারা অন্য পেশায় নিয়োজিত রয়েছে।

সূত্রমতে, বিজনেস ভিসা নিয়ে বিশে^র ১০৬টি দেশের ১৬ হাজার ৬১৬ জন নাগরিক বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এদের মধ্যে চীনা নাগরিক ৬ হাজার ৫৫৩ জন। ভিসা অন-অ্যারাইভাল নিয়ে অবস্থান করছে ২ হাজার ৯৯০ জন। চীনা নাগরিকদের এ-শ্রেণির ভিসা গ্রহণের হার বেশি। এসব দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশ দূতাবাস একজন ব্যক্তিকে কতবার বিজনেস এবং ট্যুরিস্ট ভিসা প্রদান করছে, আগমনের উদ্দেশ্য যাচাই না করার কারণে এ দুই শ্রেণির ভিসার অপব্যবহার হচ্ছে। বিশাল সিন্ডিকেটের সহায়তায় সহজে ভিসা পাওয়ায় অযোগ্যরাও যথাযথ ভিসা না নিয়ে বিভিন্ন অপরাধ ও ভিসা নীতিমালা পরিপন্থী কার্যক্রমের মাধ্যমে অবৈধ উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছে।

বর্তমানে বিজনেস ভিসায় ১ হাজার ৩৫১ জন ও ট্যুরিস্ট ভিসায় ২৪৮ জন নাইজেরিয়ান বাংলাদেশে অবস্থান করছে। ৯০ শতাংশ নাইজেরিয়ানের মধ্যে ৯৮ শতাংশ গত ১০-১২ বছর ধরে অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাস করছে। শিক্ষার্থী ভিসায় ১২ হাজার ১৯০ জন সোমালিয়া ও নাইজেরিয়ান বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের ব্যবসা, বিভিন্ন ক্লাবে ফুটবল খেলা, এদেশের নারীদের বিয়েসহ প্রতারণা করছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, অবৈধ বিদেশিদের ফিরিয়ে নিতে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে ফুটবল খেলতে আসা খেলোয়াড়রাও অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ক্লাবগুলোর ঊর্ধ্বতনদের অবহিত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে আলোচনা করে বিদেশিদের ফেরত পাঠাতে হয়। দাগী অপরাধীদের ক্ষেত্রে পুশব্যাক করার রীতিও চালু আছে।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, বাংলাদেশে ফরেনার্স অ্যাক্ট ১৯৪৬ অনুযায়ী অবৈধভাবে বসবাসের জন্য গ্রেপ্তারের পর পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিধানও আছে। এসব বিষয়ে প্রতিকারের জন্য বিজনেস ও অন-অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে আসার পর এদেশে উপার্জন করতে পারবে কিনা, পারলেও তারা কোন প্রক্রিয়ায় কতদিন পরে আয়কর দেবে সেটার সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার প্রয়োজন বলে মনে করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অপ্রযোজ্য ভিসা নিয়ে আসা বিদেশিরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। বিনিয়োগ উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এবং গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সমন্বয়ের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়ানো যেতে পারে। অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশিদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের জন্য সেফ হোম স্থাপন, ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অবস্থানের জন্য জরিমানা, দীর্ঘদিন অতিবাসকারীদের সামান্য জরিমানায় বাংলাদেশ ত্যাগের সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তাছাড়া বিদেশি নাগরিকদের ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন বাধ্যতামূলক করা হলে তাদের অবস্থানকাল, বেতন-ভাতা সহজে মনিটরিং করা সম্ভব হবে।

উৎসঃ দেশ রুপান্তর

সম্পর্কিত পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *