স্পোর্টস ডেস্ক: গত ২০ নভেম্বর রবিবার দারুণ আকর্ষণীয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শুরু হয়েছে কাতার বিশ্বকাপ। কাতারের আল বায়েত স্টেডিয়ামে ৬০ হাজার দর্শকের সামনে নানা ধরনের ইভেন্টের মাধ্যমে আরবের সংস্কৃতি তুলে ধরে দেশটি। সেই সঙ্গে ছিল বিশ্বখ্যাত কোরিয়ান ব্যান্ড বিটিএসের অন্যতম সদস্য জাংকুকের কণ্ঠে বিশ্বকাপের অফিসিয়াল থিম সং পরিবেশনা। এর আগের বিশ্বকাপে যে যে গানগুলি গাওয়া হয়েছিল, সেগুলিও ফিরে ফিরে এসেছে। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে রিকি মার্টিনের গাওয়া ‘ওলে, ওলে’ থেকে ২০১০ বিশ্বকাপে শাকিরার গাওয়া ‘ওয়াকা, ওয়াকা’, সবই শুনানো হয়েছে। বিগত বিশ্বকাপগুলোতে যেসব মাসকাট ছিল, তাদেরও একে একে হাজির করানো হয়েছে। এছাড়া বিশ্বকাপে এই প্রথমবারের মতো মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ‘আল কুরআন’ তেলাওয়াত করা হয়েছে। কাতার বিশ্বকাপের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডার ঘানেম পবিত্র কুরআন থেকে তেলাওয়াত করেন। কডাল রিগ্রেশন সিন্ড্রোমে ভোগা ঘানেম দু’হাতে ভর দিয়ে মঞ্চে এসে অভিনেতা মর্গান ফ্রিম্যানের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ সঞ্চালনা করলেন। বিশ্বকাপে ঐক্যের বার্তা শোনাতে শোনাতে হাজির হন হলিউডি অভিনেতা মর্গ্যান ফ্রিম্যান। মাঠের বাইরে সারাবিশ্বের কোটি কোটি দর্শক টিভি পর্দায় এই অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন। তবে ২০১০ সালে কাতার বিশ্বকাপের স্বাগতিক হওয়া নিশ্চিতের পর থেকেই পশ্চিমারা কাতারের মানবাধিকার লঙ্ঘন, অভিবাসী শ্রমিক নির্যাতন, গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, নারী স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে দেশটির অবস্থান, ইসলামি শরীয়াহ আইন ও এলজিবিটিকিউ -এর বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় দেশটির বিশ্বকাপ আয়োজনের বিরোধীতা করে আসছে। পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলোর নেতিবাচক প্রচারণা এই বিরোধিতা আরও উস্কে দিয়েছে। বিবিসি, গার্ডিয়ানের মতো গণমাধ্যম প্রায়ই নানা ইস্যুতে কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের নেতিবাচক দিক তুলে ধরেছে। হোমোফোবিয়ারসহ নানাবিধ অভিযোগে কাতারের সেই যে সমালোচনা শুরু হয়েছে, সেই সমালোচনা এখনও চলছে। ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হিসেবে বিডিংয়ে কাতারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার দৌড়ে যুক্তরাষ্ট্রই এগিয়ে ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত ভোটাভুটিতে ১৪-৮ ব্যবধানে নির্বাচিত হয় কাতার। সেই থেকে পশ্চিমা গণমাধ্যম কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে। পশ্চিমাদের অন্যতম প্রধান সম্প্রচার মাধ্যম বিবিসি এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানটি নিজেদের প্রধান চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার না করে তাদের আইপ্লেয়ার অ্যাপে, রেড বাটনে ও ওয়েবসাইটে দ্বিতীয় সারির স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে রেলিগেটেড কভারেজ দিয়েছে। যা নিয়ে গণমাধ্যমটির সমালোচনা চলছে। কিছু কিছু গণমাধ্যম রীতিমতো কাতার বিশ্বকাপ বয়কটের ডাক দিয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান ২০২১ সালে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে কাতারে স্টেডিয়াম বানাতে আসা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং নেপালের ৬ হাজার ৫০০ অভিবাসী শ্রমিক মারা গেছে। কাতারে অবস্থিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল গার্ডিয়ান। যদিও কাতার সরকার বলেছিল, শ্রমিক মারা যাওয়ার সংখ্যাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। কারণ যারা মারা গেছেন তারা সবাই স্টেডিয়াম নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। কাতার সরকার বলেছিল যে, তাদের দুর্ঘটনার রেকর্ড থেকে দেখা গেছে, ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বকাপ স্টেডিয়াম নির্মাণ সাইটে শ্রমিকদের মধ্যে ৩৭ জন মারা গিয়েছিল, যার মধ্যে শুধুমাত্র তিনটি মৃত্যু ছিল ‘কাজের সাথে সম্পর্কিত’। তবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, কাতারের পরিসংখ্যানে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।
“ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর কড়া জবাব”
ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো বিশ্বকাপ শুরুর আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে ইউরোপিয়ানদের নৈতিক জ্ঞান দেওয়া নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলে তাদের এক হাত নিয়েছেন। তিন হাজার বছর ক্ষমা চাওয়ার পর ইউরোপিয়ানদের নৈতিক জ্ঞান দেওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করে বলেছেন, ‘ইউরোপিয়ানদের কাছ থেকে অনেক লম্বা লম্বা জ্ঞান শুনছি। আমি ইউরোপিয়ান। গত ৩ হাজার বছর ধরে পৃথিবীজুড়ে আমরা যা করেছি। আমাদের আগামী তিন হাজার বছর ক্ষমা চেয়ে তারপর নৈতিক জ্ঞান দেওয়া উচিত। এটা ইতিহাসের সেরা বিশ্বকাপ হবে। যখন বল মাঠে গড়াবে, সবার নজর ওখানে চলে যাবে।’ এসময় একটি উদাহরণ টেনে ফিফা সভাপতি বলেন, ‘শ্রমিকদের নিয়ে আসলে কে ভাবে? ফিফা ভাবে, ফুটবল ভাবে, বিশ্বকাপ ভাবে আর যদি সত্যি কথা বলি কাতারও ভেবেছে। আজ আমার নিজেকে কাতারি মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে আফ্রিকান, মনে হচ্ছে সমকামী, মনে হচ্ছে বিশেষভাবে সক্ষম। আমার আজ নিজেকে মনে হচ্ছে প্রবাসী শ্রমিক।’ সমকামীদের প্রবেশের ব্যাপারে ফিফা সভাপতি বলেছেন, ‘আমি নিশ্চিত করতে পারি সবাইকে স্বাগতম। যদি আপনি এখানে বা ওখানে কাউকে এর বিপরীত বলতে শুনেন। তাহলে জেনে রাখুন এটা দেশের বক্তব্য না, ফিফাও এই মত জানাচ্ছে না।’ ফিফা সভাপতি কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপের প্রাক্কালে দেশটির মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে কথা তোলায় পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে ‘ভন্ডামি’র অভিযোগ করে বলেন, ‘একপক্ষীয় নৈতিক শিক্ষা শুধুমাত্র ভন্ডামি। কাতার ২০১৬ সাল থেকে যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে সেটিকে কেন কেউ স্বীকৃতি দিচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি ইউরোপ সত্যিই এসব মানুষদের নিয়ে ভাবে, তাহলে তাদের উচিৎ এসব শ্রমিকদের ইউরোপ-আমেরিকায় কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া, তাদের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দেওয়া। যেমনটি কাতার করেছে। বিশ্বকাপ ঘোষণার পর প্রথম কাতার এলাম, তখন আমি এখানকার শ্রমিকদের কাছে গিয়েছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি। মজুরি, ছুটি নিয়ে তাঁদের কিছু সমস্যা রয়েছে। কিন্তু তাঁরা কাজ করে খুশি। কেননা এই কাজ করেই তাঁরা তাঁদের পরিবারের কাছে অর্থ পাঠান।’নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করেছেন তিনি বলেন, “কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের কোনো সরকারি ব্যবস্থা নিয়ে আমরা কথা বলতে পারি না। তার পরও যেটুকু সম্ভব আমরা শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ‘আইএলও’-এর দপ্তর দোহায় রাখার নিশ্চয়তা পেয়েছি। শ্রমিকদের জন্য মেডিকেল ইন্স্যুরেন্স নিশ্চিত করেছি, তাঁদের জন্য কল্যাণ ফান্ড করেছি। যাঁরা এই শ্রমিকদের কষ্টের কথা বলে বিশ্বকাপের সমালোচনা করছেন, একবার বলুন তো তাঁরা কী করছেন? গত কয়েক বছর ধরে যেভাবে আমাদের সমালোচনা করা হয়েছে, তাতে আজ আমি প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারতাম। কিন্তু আমি মনে করি, ঘরে বসে হাতুড়ি না পিটিয়ে শ্রমিকদের পাশে থাকুন, যাতে তাঁরা সত্যিই উপকৃত হন।” এছাড়া বিশ্বকাপে ফুটবল স্টেডিয়ামে অ্যালকোহল নিষিদ্ধের বিষয়টি নিয়ে ফিফা প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘অ্যালকোহল নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত কাতার এবং ফিফা যৌথভাবে নিয়েছে। বিশ্বকাপে অনেকগুলো ফ্যান জোন থাকবে যেখানে অ্যালকোহল পাওয়া যাবে এবং সেখানে বিয়ার পান করা যাবে। আমি মনে করি দিনে মাত্র তিন ঘণ্টা (ম্যাচের সময়) বিয়ার পান না করলে আপনারা বেঁচে থাকতে পারবেন। অ্যালকোহল নিষিদ্ধের বিষয়টি যদি বিশ্বকাপের জন্য অনেক বড় ইস্যু হয়, তাহলে আমি এখনই পদত্যাগ করব এবং সমুদ্র পাড়ে গিয়ে আরাম করব।’ তিনি প্রশ্ন করেন, ‘ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, স্কটল্যান্ড সব জায়গায় একই নিয়ম। কাতার একটি মুসলিম দেশ এ কারণে বিষয়টি নিয়ে কি এত কথা হচ্ছে?’ বিশ্বকাপ নিয়ে কাতারের সঙ্গে পশ্চিমারা যা করেছেন, তাকে এককথায় ‘বর্ণবিদ্বেষী’ উল্লেখ করে ফিফা সভাপতি বলেন, ‘সুইজারল্যান্ডে এই সে দিন নারীরা ভোটাধিকার পেয়েছেন, পশ্চিমা দুনিয়াকে বলব, আগে আয়নায় নিজেদের মুখগুলো দেখুন। আমার কাছে হিসাব আছে, ইউরোপে গত ৩ বছর ২৬ হাজার মানুষ মারা গেছেন অবৈধভাবে প্রবেশ করতে গিয়ে। ইউরোপে প্রবাসী শ্রমিকরাই কাজ করেন, কিন্তু তাঁদের বৈধতা নেই। সেখানে কাতারে বৈধতা রয়েছে। অন্তত তাঁরা কাজ শেষে রাস্তায় বেরোতে পারেন। ইউরোপের মানবাধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোতে কোনো কথা বলে না। একটা একমুখো নীতি। আমাদের পৃথিবী ২১১টি দেশ নিয়ে। আমরা ফুটবলের পাশে ফুটবলের স্বার্থে সবার পাশে থাকি।’ উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি আফগানিস্তানের ঘটনা টেনে আনেন। ‘আফগানিস্তানে যখন নারী ফুটবলাররা বিপদে পড়েছিলেন, তখন আমেরিকাসহ ইউরোপের অনেক সরকারপ্রধানকে আমি নিজে অনুরোধ করেছিলাম। তাঁরা কেউ সাড়া দেননি। অবশেষে আলবেনিয়া বলেছে তারা পাশে দাঁড়াবে, কাতার বলেছে আমরা পাশে থাকব। ফুটবলের একটা সৌন্দর্য রয়েছে, ফুটবল মানুষকে দ্বিধাবিভক্ত করে না, ফুটবল একতা গড়ে।’

