জাতীয় বাজেটে সরকারের আয় ও ব্যয়ের পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। আর আয়ের একটা বড় অংশই আসে রাজস্ব খাত থেকে।
চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিলো। যদিও মহামারি পরবর্তী ইউরোপ যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট ও ডলার সংকটে এই লক্ষ্যমাত্রাকে অস্বাভাবিক বলেছিল অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতিবিদদের কথাই সঠিক হতে যাচ্ছে।
রাজস্ব বোর্ড সূত্র বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায়ে ৩৪ হাজার ৬৩১ কোটি টাকার ঘাটতি হয়েছে। এই দশ মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা, আলোচ্য সময়ে আদায় হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। যদিও রাজস্বের এই আহরণ বিগত অর্থবছরের চেয়ে ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ বেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি হয়েছিলো। এবার দুই মাস বাকি থাকতেই রাজস্ব ঘাটতির রেকর্ড তৈরি হয়েছে।
আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ১৯ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। মোট রাজস্ব ঘাটতির অর্ধেকেরও বেশি হয়েছে এ খাত থেকে। একই সময়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাটে ঘাটতি হয়েছে ১০ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা। আয়কর খাতে ঘাটতির পরিমাণ ৫ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা।
আমদানি খাতে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। এপ্রিল পর্যন্ত এ লক্ষ্য ছিলো ৯৩ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। আর রাজস্ব আদায় হয়েছে ৭৪ হাজার ২২১ কোটি টাকা। যদিও আমদানির এই আয় ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি।
ভ্যাটে চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। আর এপ্রিল পর্যন্ত ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ১ লাখ ৮ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। যার বিপরীতে ভ্যাট আদায় হয়েছে ৯৮ হাজার ১৪ কোটি টাকা। যদিও ভ্যাটের এই আয় ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি।
২০২২-২৩ অর্থবছরে আয়কর ও ভ্রমণ কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ২২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এপ্রিল পর্যন্ত আয়কর ও ভ্রমণ কর খাতে ৮৩ হাজার ৪২৮ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৭৮ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। যদিও আয়কর খাতে এই আয় ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ বেশি।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি অর্থবছরে শুরু থেকে দেশে ডলার সংকট প্রকট ছিলো। সরকার অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানিকে নিরুৎসাহিত করেছে। এলসি খোলার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি এসেছে, সেটেলমেন্টও কমেছে। আমদানি ঋণাত্মক হয়ে যাওয়ায় শুল্ক আদায়ও কমে গেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চলতি অর্থবছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। বিগত অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় ঘাটতি থাকবে। যার প্রভাব পড়বে নতুন অর্থবছরের বাজেটে।
রাজস্ব আদায় সন্তোষজনক না হলে সরকার অভ্যন্তরীণ ঋণ নিতে বাধ্য হয় বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, এর ফলে বেসরকারি খাত সেভাবে ঋণ পায় না। শিল্পপ্রতিষ্ঠান এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও এটা বড় বাধা।
তিনি বলেন, আমদানি কমে যাওয়ায় শুল্ক খাত থেকে রাজস্ব কম আদায় হয়েছে। তবে ভ্যাট ও আয়কর থেকে এনবিআর আরও বেশি রাজস্ব আদায় করতে পারতো।
রাজস্ব বোর্ড কর্মকর্তারা বলছেন, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয় অর্থমন্ত্রণালয়। যা বেশিরভাগ সময়ই বাস্তবসম্মত হয় না। রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হওয়া উচিত।