দীর্ঘমেয়াদি ঋণ শ্রেণিকরণ বা ক্লাসিফায়েড হিসেবে তালিকাভুক্ত করার সময় ছয় মাস থেকে কমিয়ে তিন মাস করার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই পরিকল্পনা করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পদক্ষেপের ফলে খেলাপি ঋণ নিয়ে তারা গভীর সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছেন। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এই ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা যখন এলসি বা ঋণপত্র খুলেছেন, তখন প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা। সেই এলসির অর্থ এখন ১০৮ টাকা প্রতি ডলারে পরিশোধ করতে হচ্ছে তাদের।
এছাড়া করোনাভাইরাস মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে নাস্তানাবুদ অবস্থা বিরাজমান। এর সঙ্গে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানাগুলোতে চলমান সংকট মোকাবিলায় অসহায় হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. আমিন হেলালী বলেন, ‘ওভারডিউ ঋণ শ্রেণিকরণের সময় ছয় মাস থেকে কমিয়ে তিন মাস করা হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যাপক বেড়ে যাবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
আমিন হেলালী বলেন, ‘এমনিতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। এর মধ্যে আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ শ্রেণিকরণের সময় কমানো হলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। হুমকিতে পড়বে বেসরকারি খাত।’
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ব্যারিস্টার সামীর সাত্তার বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত ঋণের ক্লাসিফিকেশনের মেয়াদ ছয় মাস থেকে তিন মাসে কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত খেলাপি বা খেলাপি ঋণ আরও বাড়াতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে এই সিদ্ধান্ত খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য, তবে প্রকৃতপক্ষে তা খেলাপি ঋণ বাড়িয়ে দিতে পারে। বর্তমান অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে যখন ব্যবসায়ীরা স্ট্রাগল করছেন, যেখানে বেসরকারি বিনিয়োগ কিছুটা নিম্নগামী, এমন অবস্থায় এ সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
ব্যারিস্টার সামীর সাত্তার আরও বলেন, ‘এলডিসি থেকে উত্তরণের আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকালীন সময়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বাণিজ্যের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা এমনিতেই বেশ সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, তখন এ ধরনের সিদ্ধান্ত বেসরকারি বিনিয়োগকেও বাধাগ্রস্ত করবে।’
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতির পরামর্শ, এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেয়ে বরং ব্যাংকের যে পরিমাণ টাকা ইতোমধ্যে খেলাপি বা এনপিএল হিসেবে রয়েছে, তা দক্ষতা ও দ্রুততার সঙ্গে আদায়ের প্রক্রিয়া আরও জোরদার করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়ার জন্য তাদের গাইড লাইন অনুসারে দীর্ঘমেয়াদি ঋণকে ক্লাসিফায়েড হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য ওভারডিউ পিরিয়ড ছয় মাস থেকে কমিয়ে তিন মাস করার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম ও খেলাপি ঋণ কমাতে এ ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
কোভিডের কারণে ২০২০ সালে ব্যবসায়ীরা কোনো ধরনের ঋণ পরিশোধ না করে খেলাপি থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। ২০২১ সালে ঋণের মাত্র ১৫ শতাংশ পরিশোধ করে তারা খেলাপি অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। ২০২২ সালের শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধের এই বিশেষ ছাড় তুলে নিলেও এ সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারেনি। ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা ব্যবসা কার্যক্রমের অস্বাভাবিক ক্ষতি বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ঋণ পরিশোধের ছাড়ের আবেদন জানান।
ব্যবসায়ীদের ওই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শিল্পঋণ, কৃষিঋণ ও সিএমএসএমই ঋণ পরিশোধে ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও ২০২৩ সালের শুরুর দিকে এই সুবিধা তুলে নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মাত্র তিন মাসের জন্য সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারে। ফের ব্যবসায়ীদের একই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছর এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সব চলতি মূলধন ও মেয়াদি ঋণের ৫০ শতাংশ ঋণ পরিশোধে খেলাপি হবে না বলে বিশেষ ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও চলতি বছর জুলাই থেকে এ সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ঋণ পরিশোধে কোনো বিশেষ সুবিধা নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান নিয়ম অনুসারে, ছয় মাসের ওভারডিউ পিরিয়ডের পরে একটি মেয়াদি ঋণকে ‘সাবস্ট্যান্ডার্ড’ হিসেবে ক্লাসিফায়েড (শ্রেণিভুক্ত) করা হয় এবং নয় মাস পর ঋণটিকে ‘মন্দ বা লোকসানি’ হিসেবে ক্লাসিফায়েড করা হয়।
গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিদর্শনে দেখা গেছে, ব্যাংকগুলো প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ গোপন রেখেছে। চলতি বছর প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। মার্চ মাসে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকায়, যা মোট বকেয়া ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, যেকোনো ওভারডিউ ঋণ বা কিস্তির জন্য চলমান বা ডিমান্ড ঋণের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বকেয়া ঋণের ওপর এবং মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে ওভারডিউ কিস্তির ওপর ১ দশমিক ৫ শতাংশ দণ্ডসুদ আরোপ হবে।
২৭ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নতুন নিয়ম চালু করে। এ নিয়মানুসারে ব্যাংকগুলো ওভারডিউ ও ক্লাসিফায়েড ঋণের ওপর সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৫ শতাংশ দণ্ডসুদ নিতে পারবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ভালো ঋণগ্রহীতাদের উৎসাহিত করতে এবং মন্দ বা ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের নিরুৎসাহিত করতে খেলাপি ঋণের ওপর ফের দণ্ডসুদ আরোপ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনুরোধ করেছে ব্যাংকগুলো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইএমএফের শর্তানুযায়ী এমন পদক্ষেপ নিতে পারে। তবে এটি ক্লাসিফায়েড ঋণের পরিমাণ অনেক বাড়িয়ে দেবে।
‘দেশের সিংহভাগ ঋণই মেয়াদি ঋণ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। এর মধ্যে তিন মাস পর ঋণ ক্লাসিফায়েড করা হলে খেলাপি ঋণ ব্যাপক বেড়ে যাবে’—যোগ করেন সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।

