শিরোনাম
বৃহঃ. ডিসে ৪, ২০২৫

আহমদ ছফার ‘নিহত নক্ষত্র’ যেন এক অসম্ভব জীবনবোধের গল্প

।। মো. ইয়াকুব আলী ।।

এই বইয়ে গল্প আছে মোট সাতটি। তারমধ্যে বইয়ের প্রথম গল্পের নামেই বইয়ের নামকরণ। এই গল্পটা নিয়ে আসলে একটা আলাদা বই হতে পারতো। গল্পটা নিয়ে তাই আমরা সবার শেষে আলোচনা করবো। দ্বিতীয় গল্পের নাম ‘গন্তব্য’। মানুষের অফুরাণ প্রাণশক্তির গল্প এটা। অদম্য ইচ্ছেশক্তিকে অবলম্বন করে আসলে মানুষ অসাধ্যকে সাধন করতে পারে, পৌঁছে যেতে পারে নিজের গন্তব্যে। তৃতীয় গল্পের নাম ‘পদাঘাতের পটভূমি’। এতদঞ্চলের চিরায়ত জীবন সংগ্রামের গল্প এটি। এই গল্পের দুটো লাইন এমন, ‘আল্লাহ যে গরিবের নয়। কাজিবাড়ি, মিয়াবাড়ি, সাহাবাড়ি পেরিয়ে আল্লাহর রহমত তার দুয়ারে চারটে চকচকে মারবেল হয়ে ঝরে পড়তে পারে না। কোনোদিন না।’

‘আস্বাদ’ গল্পটি এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আনন্দের গল্প। পরিস্থিতি যাইহোক না কেন এই বেঁচে থাকতেই আমাদের আনন্দ। গল্পের চরিত্র আলমের স্বগোতোক্তিতে লেখক লিখেছেন, ‘আলমের খেয়াল হলো সে বেঁচে আছে। কুৎসিত মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে পেরেছে। এ আনন্দে পাগলের মতো নাচতে লাগল। হৃৎপিণ্ডের শব্দের তলায় ট্রেনের শব্দ চাপা পড়ে গেলো। জীবনের ঘন গভীর এমন স্বাদ আর কোনোদিন পায়নি আলম।’ ‘প্রতিপক্ষ’ গল্পে লেখক মানুষের প্রতিপক্ষ হিসেবে ষড়রিপুর এক রিপু ‘কাম’কে দাঁড় করিয়েছেন। একবার কামের ফাঁদে পড়লে সেখান থেকে আর সহজে উদ্ধার পাওয়া যায় না।

‘কবি’ গল্পটা আমাদের সৌন্দর্যবোধের গল্প। ঐশ্চর্য আসলে কোথায়? আমরা আসলে কি নিয়ে সুখী হতে চাই? এমনসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে এই গল্পে। এই গল্পের কয়েকটা লাইন এমন, ‘কচি কচি পাটের চারায় বৈকালিক মেঘভাঙা সূর্যের চারিয়ে যাওয়া রং, নিতল জলের আরশি, ঘনপাটের আন্দোলিত শীর্ষদেশ। আমি এ তল্লাটে পাটের দেশে নতুন বলে এসব হয়ত আমার চোখে কিছুটা কাঁচা সোনার অঞ্জন মাখিয়ে দেয়। কলকারখানার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চোখ দিয়ে দেখি বলে সুন্দর লাগে। কিন্তু এ লোকটা জীবনের চল্লিশটি বছর ধরে উদয়াস্ত এই দৃশ্য দেখছে। তারপরে কেমন আকুল আগ্রহভরে নিজে দেখে, পরকে দেখিয়ে বলে দেখুন সুন্দর। কোথাও আপনি এমনি একটি দেখতে পাবেন না। মানুষের সৌন্দর্যচেতনার পরমায়ু কতদিন?’

এই গল্পে কবিতা কেমন হতে হবে সেই বিষয়েও লেখক আলোকপাত করেছেন, ‘দুঃখটা কবিতা নয়, দুঃখের অধিক দুঃখ, আনন্দের অধিক আনন্দ না থাকলে কবিতা কবিতা হয়ে ওঠে না। যাতে সব মানুষের অন্তরের গভীর দুঃখ ভাষা পায়। একজনের দুঃখে সমগ্র মানুষের মনে দুঃখবোধ জাগে।’ এই গল্পে লেখকের একটা কবিতাও স্থান পেয়েছে। তার প্রথম কটি পক্তি এমন-

‘আমি এক নির্মম পথিক এই পৃথিবীতে

আমার অন্তর ভরা তীব্র হলাহল

বেদনা যাতনা মাখা দুঃসহ অনল

তরল রক্তের স্রোতে লোলুপ রসনা;

তীব্র রোষে কয় মোরে ক্ষমা করিব না।’

‘হাত’ গল্পটা একজন লেখকের জীবনের গল্প। লেখালেখি করতে হলে সেই বিষয়ে প্রয়োজন চেনাজানা আর নিবিড় পরিচয়। আর টাকার বিনিময়ে যেটা লেখা হয় সেটা আসলে আবর্জনা ছাড়া আর কিছুই না। এই গল্পে সময়ের পাল্লায় জীবনের ক্ষুদ্রতাবোধ নিয়েও লেখক আলোকপাত করেছেন। এই গল্পের চরিত্র আনোয়ার আজিম’র ভাষায়, ‘কত অল্পেই শরীরে সঙ্গীত ঝরার ঋতু ফুরিয়ে যায়। কত সংক্ষিপ্ত এ জীবন। তবু পৃথিবীতে অক্ষুন্ন থাকে আশ্চর্য আর অপরূপ। বুকের ভেতর আশ্চর্যকে ধারণ করে ছন্দিত বেহালার মতো কেমন করে প্রকাশের বেদনায় কেঁদে ওঠে জীবন। এখনো পৃথিবীতে আশ্চর্যের রঙিন চিঠি সাময়িকপত্র ডাকঘরের পথে হেঁটে হেঁটে বাড়ি গিয়ে আসর জমায়। ব্যবসা, বাণিজ্য, হিসেব-নিকেশ তুচ্ছ মনে হল। মনে হলো সমস্তটা জীবন ধরে কেবল জঞ্জালই বাড়িয়ে চলেছেন।’

‘নিহত নক্ষত্র’ গল্পটা নিয়ে লেখক যদি একটা উপন্যাস লিখতেন তাহলে আরও বেশি ভালো হতো। এই গল্পটা পাঠক বারবার পড়বেন জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে। আর এই পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্বের মূল্যায়ন করবেন বলেই আমার বিশ্বাস। একজন বাংলাদেশি হিসাবে জন্ম নিয়ে আমাদের দায়িত্ব কর্তব্য কেমন হতে পারে সেই বিষয়ে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি সেই চেষ্টা করতে যেয়ে কি ধরনের পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে সেই বিষয়েও আলোকপাত করেছেন। বহুমাত্রিক এই ছোটগল্পের একটা করে পাতা ওল্টানো যাক এইবার। এই গল্পের মূল চরিত্র মুনতাসীর। কিন্তু এই গল্পটা পড়তে শুরু করলেই পাঠকের মনে খটকা লাগবে যে এই মুনতাসীর কি আসলেই স্বয়ং লেখক নন?

লেখকদের ঔচিত্যবোধ বিষয়ে মুনতাসীর বলেছেন, ‘লেখকদের তো অনেক কিছু উচিত। কিন্তু তার আগে লেখকদের কি উচিত নয়, যে শ্রেণিকে উপদেশ দিচ্ছেন, তাদের চরিত্র এবং মানসিকতা সম্মন্ধে সঠিকভাবে ওয়াকিফহাল হওয়া। শ্রমিকদের দেখলেন না, জানলেন না, পথ বাতলানো দরকার মনে করলেন, অমনি নরম বিছানায় ঘুমিয়ে গল্প ফেঁদে বসলেন। সেটা কি উচিৎ?…সাহিত্য সাহিত্যই, শ্রমিককে নিয়ে লিখুন, আর বড় লোককে নিয়ে লিখুন এবং মানুষ-মানুষ। কথায় কথায় রুশ চীনের দোহাই দিলে নিজেদের অজ্ঞতা ও আলস্য ঢাকা পড়ে না।’ সাহিত্যিকের কাজ মানুষের সমষ্টিগত জীবনের পূর্ণাঙ্গ একটা ধারণা দেওয়া। সে কাজ অনেকটা নির্মোহ বিজ্ঞানীর।

আর সাহিত্যের স্বরূপ সন্ধান করতে যেয়ে মুনতাসীর বলছেন, ‘এ দেশে সাহিত্য আছে নাকি? সাহিত্যিকদের দেখলে আমার ঘেন্না হয়। একদল নুনের ঠোঙার মত কাঁচা যৌবনের বেসাতি করছে। আরেকজন লিভিডোর ফাঁদে আটকা পড়েছে। কেউ কেউ শাহবাগ হোটেলে মিটিং করে জনগণের সাহিত্য করার জন্য নসিহত করছেন। প্রবীণ সাহিত্যিকদের দখলে আমার বর্ষীয়সী বারাঙ্গানার কথা মনে হয়। আর কেউ কেউ সাহিত্য বলতে বোঝেন বিদেশি নেতার বাণী। আমাদের ঘিরে রয়েছে এক নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। শুয়োরের মত আদর্শের নামে, মানবতার নামে খুব উঁচু একটা লাফ দিয়ে আবার পুরোনো কাদায় গড়াগড়ি দিচ্ছি। রাজনীতি নেই, সাহিত্য কাদায় নেমেছে- নামতে বাধ্য।’

আর রাজনীতি এবং রাজনৈতিক নেতাদের নিয়েও এই লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে বলা হয়েছে, ‘এ পর্যন্ত এমন একজন নেতার নাম বলুন যিনি রাজনীতি করে পয়সাঅলা হননি। কেউ কেউ মুখে মুখে কল্যাণের কথা বলেন বটে, কিন্তু তারা ব্যক্তিগত জীবনে এমন সব বিশ্বাসকে পুষে রাখেন, দেখলে ঘেন্না হয়। সুতরাং তাদের কাছ থেকে আশা করার মতো কিছু নেই। অনেকের কল্যাণ করার ইচ্ছে হয়তো আছে। কিন্তু তাদের চিন্তা পীড়িত, চেতনা আচ্ছন্ন, দৃষ্টি সীমিত। সেজন্য তারা সব সময় গরুর গাড়ির সঙ্গে রকেট এঞ্জিনের পার্টস সংযোজন করতে চান। তা হবার নয়। দেশ জনতার কল্যাণ যে-কোন লোক ইচ্ছা করলেই করতে পারে না। সেজন্য মনীষা, আন্তরিকতা, প্রীতি এসবেরই প্রয়োজন বেশি। আমাদের নেতাদের মধ্যে সে জিনিসগুলোই নেই। নিজেরা এক একটা কুসংস্কারের ডিপো। অথচ দেশের মধ্যে জ্ঞানের সূর্য জ্বালাবার দুঃসাহস করেন। ওটা নেহায়েত ফাঁকিবাজি।’

বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থার বিবেচনায় মুনতাসীর বলেছেন, ‘কী নেই আমাদের? মোল্লা আছে, মৌলানা আছে, রসের কথা লেখার সাহিত্যিক আছে, যাত্রাদলের রাজনীতি আছে. ড্রয়িং রুমের সংস্কৃতি আছে, গুলিস্তান পর্যন্ত লংমার্চ আছে। মেঘনার তরল পলির মতো স্তরে স্তরে কুসংস্কার আছে, অত্যাচার আছে, নির্যাতন আছে। দোকানদার আছে, শিল্পপতি আছে, মাদরাসা, মসজিদ, অধ্যাপক, সাংবাদিক সব আছে।’

এছাড়াও আমাদের মানসিকতা নিয়ে মুনতাসীর বলেছেন, ‘অরাজক যুগের একরকম হুজুগ বলতে পারেন। কারণ যারা স্লোগান দিচ্ছে, মিছিল করছে, জেল খাটছে, তারাও প্রাণের থেকে চায় না, এ সমাজের পরিবর্তন হোক। সেজন্য গুলিস্তান পর্যন্ত মিছিল করে মনে করে, লং মার্চ করে এলাম। আমাদের ভেতরে স্তরের পর স্তর এত কুসংস্কার – অন্তর দিয়ে কোন কিছুকে গ্রহণ করতে পারি না। আমাদের রক্ত মাংসে সত্যের আগুন জ্বলে না। রোমান্টিকতার বাইরে এক কদম দেবার সামর্থ্যও আমাদের নেই।’

সর্বোপরি আমাদের রাজনীতি, সংস্কৃতি আদর্শের বড় নামের ঢোলা জামা পরে যে দিকে ছুটছে, সে লক্ষ্য বস্তুটির নাম অন্ধকার। মুসলমান সমাজ এখনো চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে রামমোহনের স্তর অতিক্রম করেনি। যাদের ভয়ঙ্কর প্রগতিশীল মনে করে সভা করে গলায় মালা দুলিয়ে দিই, তারাও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। ভালো করে টিপলে দেখা যাবে মানুষপচা গন্ধ বের হয়।

ভেতরে নোংরা, ওপরের চটকদার চেহারাটুকুই চোখে পড়ছে। রাজনীতিবিদেরা যুবকদের সমাজ বদলের কাজে না লাগিয়ে তোষামোদের কাজে লাগিয়েছে। তাতে করে যুবশক্তির মেরুদন্ড ভেঙে দিয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খুনেদের মুখের আদলের কোনো তফাৎ নেই। দুর্বলকে শক্তি দেবার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মতো কোনো আদর্শ নেই।

এমন স্যাতস্যাতে পরিবেশ থেকে বের হবার রাস্তাও লেখক বাতলে দিচ্ছেন। বাঁচতে হলে একেকজন যুবককে একেকটি পারমাণবিক বোমার মতো বিস্ফোরণক্ষম হতে হবে। চাই একদল চিন্তাশীল নির্ভীক মানুষ, যারা দক্ষ সার্জনের মত সমাজ দেহে অস্ত্রোপচার করতে পারে। মানুষ কাঠ নয়। একদিন না একদিন সত্যকে গ্রহণ করবেই। তার জন্য চাই সহনশীলতা, ধৈর্য আর গ্রহণ বর্জনের ক্ষমতা। সর্বোপরি সত্য প্রকাশের দুর্বার সাহস। এক সময় দেশের অধিকাংশ মানুষের মনে সত্যের আগুন জ্বলে উঠবে। এমনি করেই অন্ধকার যুগের গর্ভযন্ত্রণা সৃষ্টিশীল যুগের জন্ম দিবে। আমাদের সৃষ্টিশীল চিন্তার অভিঘাতে পুরোনো যুগ তলিয়ে যাবে। পাঁজর ফাটানো চিন্তা বিজলীর মতো জ্বলবে যখন, আবার নতুন যুগ আসবে। এখন শুধু বলা উচিত, যার বুকে সূর্য নেই, সে আমাদের বন্ধু নয়।

সম্পর্কিত পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *