শিরোনাম
শনি. ডিসে ৬, ২০২৫

‘প্রেমে’ পড়ে ফ্ল্যাটে গমন, অতঃপর যা ঘটে

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বায়েজীদের (ছদ্মনাম) সঙ্গে পরিচয় হয় শাহনাজের। এক বছরের বেশি সময় ধরে চলে তাদের কথাবার্তা। দুজনের সম্পর্ক গভীর হওয়ায় ১৫ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে দেখা করেন তারা। অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে শাহনাজ আর বায়েজীদ চলে যান নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। ওঠেন সেখানকার একটি ফ্ল্যাটে। কিছুক্ষণ পরই অজ্ঞাত দুই নারী শাহনাজের বান্ধবী পরিচয়ে সেখানে প্রবেশ করেন। এরপর ডিবিপুলিশ পরিচয়ে আরও ৫-৬ জন ওই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন। তারা বায়েজীদকে মারধর করেন এবং তার পরনের কাপড়-চোপড় খুলে নগ্ন অবস্থায় শাহনাজের পাশে দাঁড় করিয়ে ভিডিও ধারণ করেন। এ সময় প্রেমের ফাঁদে ফেলা শাহনাজ কিছু না জানার ভান করে কাঁদতে থাকেন। চক্রটি বায়েজীদের কাছে ২০ লাখ টাকা দাবি করেন এবং তা না দিলে ধারণ করা ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন।

গত ১৮ ও ২০ আগস্ট ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও বরগুনায় ধারাবাহিক অভিযানে এই চক্রের দুই নারী সদস্যসহ আটজনকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম উত্তর বিভাগ। চক্রটি গত চার বছরে অভিনব উপায়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

জানা গেছে, ফেসবুকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের টার্গেট করে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাতেন চক্রের সদস্যরা। সুন্দর চেহারার মেয়ের আইডি দেখে কেউ রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করলে মেসেঞ্জারে শুরু হতো কথোপকথন। অল্প সময়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ার পর দেয়া হতো হানি ট্র্যাপিংয়ের প্রস্তাব। এতে রাজি হলে নিয়ে যাওয়া হতো আগেই ঠিক করে রাখা ফ্ল্যাটে। সেখানে যাওয়ার পর বিশেষ মুহূর্তে একদল লোক ভিডিও করতে করতে রুমে প্রবেশ করত। কেউ পরিচয় দিত ডিবি কর্মকর্তা, কেউ বা সাংবাদিক।

চক্রের অন্য সদস্যরা ভিকটিমকে মারধর করে নগ্ন অবস্থার ভিডিও ধারণ করে পরিবারকে দেখানো ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নিতেন লাখ লাখ টাকা।

এসব তথ্য যেন কাউকে না জানানো হয় সেজন্য স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে রাখতেন চক্রের সদস্যরা। এভাবে গত চার বছরে ৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে চক্রটি।

ডিবি সূত্রে জানা গেছে, জিম্মি করা ভুক্তভোগী বায়েজীদের কাছে থাকা ছয় হাজার টাকা এবং একটি ব্যাংকের ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড ও পিন নম্বর জেনে নেন চক্রটির সদস্যরা। পরে ডেবিট কার্ড দিয়ে এটিএম বুথ থেকে তিন লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়। আর ক্রেডিট কার্ড দিয়ে একটি জুয়েলার্স থেকে চার লাখ ৪ হাজার টাকার সোনা কিনে নেয়। পরে হত্যা ও ভিডিও প্রকাশের হুমকি দিয়ে বায়েজীদকে নারায়ণগঞ্জের ভুইগড় বাসস্ট্যান্ডে এনে ছেড়ে দেন।

হানি ট্র্যাপিংয়ের ফাঁদে ফেলে চক্রটি ডিবি পুলিশ পরিচয়ে মারধর ও প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে বায়েজীদের কাছ থেকে মোট ৭ লাখ ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। পরে তিনি এ বিষয়ে ডিএমপির উত্তরা পূর্ব থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলার তদন্তে হানি ট্র্যাপিংয়ের সদস্যদের সন্ধান পায় ডিবি।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, এই চক্রে শাহনাজ, রিমা ও লাভলী নামে তিনজন নারী রয়েছেন। তারা ফেসবুক ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রেমের ফাঁদে ফেলতেন এবং হানি ট্র্যাপিংয়ের কাজ করতেন। খুব দ্রুত তারা টার্গেট ব্যক্তিকে ঘনিষ্ট করে নিয়ে এ ধরনের কাজ করতেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৮ আগস্ট চক্রের সদস্য আব্দুস সালাম, নাজমুল হাসান, মাসুম শেখ ও শওকত আলী শেখকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদেরকে আদালতের মাধ্যমে পাঁচদিনের রিমাণ্ডে আনা হয়।

এছাড়া ২০ আগস্ট চক্রের জাহিদুর রহমান তুষার, মাসুদুর রহমান মিলন, মনজুমা বেগম ওরফে শাহিনুর আক্তার ওরফে শাহনাজ ও রিমা আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদেরকে আদালতের মাধ্যমে তিনদিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে। এসময় দশটি মোবাইল, ২১টি সিম কার্ড, ৪১ হাজার টাকা, একটি সোনার চেইন ও একটি সোনার আংটি জব্দ করা হয়।

ডিবি বলছে, গ্রেপ্তার তুষার এই চক্রের মূল হোতা, যার কাছে চক্রের নারী সদস্যরা টার্গেট নির্ধারণ করে তথ্য প্রদান করতেন। মো. মিলন চক্রের সহযোগী এবং ভুয়া ডিবির সদস্য। আর শাহনাজ মূলত টার্গেটদের সঙ্গে কথা বলে প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রলোভন দেখাতেন। ট্র্যাপিংয়ের জন্য ব্যবহৃত বাড়ি ভাড়া করতেন। এই চক্রের মোট সদস্য ১১ জন।

ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) তারেক আহমেদ বলেন, ‘চক্রের নারী সদস্যরা ফেসবুক ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে টার্গেট ব্যক্তিকে প্রেমের ফাঁদে ফেলত। পরবর্তীতে তাকে জিম্মি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিত। হানি ট্র্যাপিংয়ের এই চক্রটি ৩-৪ বছর ধরে প্রতারণা করে আসছিল। বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তিকে হানি ট্র্যাপিংয়ের ফাঁদে ফেলে ২-৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।’

ডিসির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আশরাফ উল্লাহ বলেন, ‘অল্পসময়ের পরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে অপরিচিত কোনো স্থানে না যাওয়া, অপরিচিত কোনো নারীর সঙ্গে ফেসবুকে প্রেমের বা বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপনে সতর্ক থাকা দরকার।’

তাছাড়া অপরিচিত কোনো স্থানে যাওয়ার আগে পরিবারের সদস্যকে বা কাছের কোনো ব্যক্তিকে অবহিত করা এবং প্রতারিত হলে দ্রুত পুলিশের সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দেন সাইবার পুলিশের এই কর্মকর্তা।

সম্পর্কিত পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *