- হাসপাতালে ভয়াবহ বোমা হামলা
- জাতিসংঘ মহাসচিবের কঠোর নিন্দা
- ফিলিস্তিনে ৩ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা
- ইসরাইলি বর্বরতায় মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ
- জো বাইডেনের সঙ্গে আরব নেতাদের বৈঠক বাতিল
- গাজায় যুদ্ধের দায়ভার যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের: হামাস
- ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইরানের একযোগে অবরোধ আরোপের আহ্বান
লণ্ডন, যুক্তরাজ্য:: গাজায় এখন আর কোনো নিরাপদ স্থান নেই। সর্বত্র পড়ছে ইসরাইলি বোমা। গাজায় ইসরাইলি বোমার আঘাতে প্রতি ১৫ মিনিটে একটি শিশু নিহত হচ্ছে। আবাসিক ভবন, স্কুল, মসজিদ, হাসপাতাল সবই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। মঙ্গলবার রাতে আল আহলি হাসপাতালে বর্বর হামলায় নিহতের সংখ্যা ৮০০ ছাড়িয়ে গেছে। ‘মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে’ দিগ্বিদিক ছুটছেন গাজার বাসিন্দারা। কোথাও আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছেন না। বিশেষ করে শিশুদের নিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় গাজাবাসী।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, হাসপাতালটিতে অসুস্থ রোগী ও আশ্রিত মানুষ ছাড়া আর কেউ ছিল না। এটা নৃশংস গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ। এছাড়া বুধবার উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে পৃথক ইসরাইলি বিমান হামলায় কমপক্ষে ৩৭ জন নিহত হয়েছেন। একজন চিকিৎসক বলেছেন, এ হাসপাতালকে টার্গেট করার আগে কোনো সতর্কবার্তা দেওয়া হয়নি। প্রায় তিন হাজার মানুষ ভেতরে ছিলেন। কী দিয়ে হামলা হয়েছে জানি না। শিশুদের শরীর ছিন্নভন্ন হয়ে গেছে। আরেক বাসিন্দা বলেন, যারা মারা গেছে সবাই বেসামরিক। তাদের কোনো অস্ত্র ছিল না। বুধবার অনেক স্বজনকে প্রিয়জনের লাশ খুঁজতে গিয়ে লাশের টুকরোগুলো সংগ্রহ করতে দেখা গেছে।
স্মরণকালে ভয়াবহ এ হামলায় হতবাক বিশ্ব। একে ‘নৃশংস যুদ্ধাপরাধ’ বলছে আরব বিশ্ব। হাসপাতালে হামলার ঘটনায় বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। আরব নেতাদের পাশাপাশি পশ্চিমারাও এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। বিভিন্ন দেশে ইসরাইলবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। জাতিসংঘ, রাশিয়া ও জার্মানিসহ বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ এ ঘটনার পুঙ্খানুপঙ্খ তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
৭ অক্টোবর থেকে গেল ১২ দিনে গাজায় ইসরাইলি হামলায় ৩৩০০ ফিলিস্তিনি নিহত ও ১৩ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন। আলজাজিরা, স্কাই নিউজ, নাইননিউজ, বিবিসি ও এএফপিসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এই খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, গাজা পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। গেল ৭ থেকে ১৫ অক্টোবরের মধ্যে গাজার ১১১টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ছোট-বড় হামলা হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেন, আমি বাকরুদ্ধ। শত শত মানুষের মৃত্যু হলো। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই সংঘাত ও হত্যা এখনই বন্ধ করতে হবে। প্রভাবশালী দেশগুলোর এজন্য চেষ্টা করা উচিত। বেসামরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। মানবিক সহায়তা পৌঁছানোরও সুযোগ দিতে হবে।

জাতিসংঘ মহাসচিবের কঠোর নিন্দা!
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, গাজায় হাসপাতালে হামলা চালিয়ে শত শত বেসামরিক নাগরিককে হত্যার ঘটনায় তিনি ‘হতভম্ব’। এ হামলার কঠোর নিন্দা জানিয়ে হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছেন তিনি। ইউএন নিউজে বলা হয়েছে, গতকাল মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (টুইটার) দেয়া পোস্টে আন্তোনিও গুতেরেস আরো বলেছেন, আন্তর্জাতিক আইনে সব হাসপাতাল ও চিকিৎসাকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা আছে। এর আগে গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সহায়তাবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ পরিচালিত একটি স্কুলে হামলার ঘটনায়ও নিন্দা জানিয়েছেন গুতেরেস। তার মুখপাত্র এক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ফিলিস্তিনে ৩ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা!
গাজা উপত্যকার ইসরাইলি বাহিনীর বর্বরোচিত বিমান হামলায় ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস মঙ্গলবার তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছেন। ফিলিস্তিনের সরকারি বার্তা সংস্থা ওয়াফা পরিবেশিত খবরে বলা হয়, মাহমুদ আব্বাস এ ঘটনায় ‘তিন দিনের সরকারি শোক ঘোষণা করেছেন এবং আল-আহলিল আরব হাসপাতালে গণহত্যায় শহীদদের ও আমাদের দেশের নিহত সকল শহীদদের জন্য জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
ইসরাইলি বর্বরতায় মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ!
গাজার হাসপাতালে ইসরাইলি বোমা হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি বড় শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। পশ্চিম তীরের বেশ কয়েকটি শহরে রাতেই ফিলিস্তিনিরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন। বিভিন্ন জায়গায় তারা পাথর ছুঁড়তে থাকেন নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে। সেখানে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়া হয়। একপর্যায়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নিরাপত্তা বাহিনী কাঁদানে গ্যাস ও স্টান গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। অন্যদিকে লেবাননের রাজধানী বেইরুতে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের সামনে হাসপাতালে বিস্ফোরণের ঘটনায় ক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীরা জড়ো হয়। এছাড়া ফরাসি দূতাবাসের বাইরে আরেকটি দল জড়ো হয় এবং ভবনটি লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়ে বলে জানা গেছে। এর বাইরে ত্রিপোলি এবং লিবিয়ার অন্যান্য শহরেও শত শত মানুষ ফিলিস্তিনি পতাকা বহন করে এবং গাজাবাসীদের সমর্থনে স্লোগান দেয়। এদিকে হাসপাতালে ইসরাইলি বাহিনীর বোমা হামলায় শত শত মানুষের মৃত্যুকে ‘জঘন্য অপরাধ’ অভিহিত করে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ইসরাইলি বাহিনীর হাসপাতালে বোমা হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে কাতার। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ইসরাইল যেভাবে গাজার হাসপাতাল, স্কুল ও জনবহুল এলাকায় হামলা করছে, এতে সংঘাত ভয়ঙ্করভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান বলেছেন, ইসরাইল যে ন্যূনতম মানবিক মূল্যবোধেরও তোয়াক্কা করছে না, গাজায় হাসপাতালে হামলা তার সর্বশেষ উদাহরণ। গাজায় ‘নজিরবিহীন নৃশংসতা’ বন্ধে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গাজার আল–আহলি হাসপাতালে ইসরাইলি হামলার নিন্দা জানিয়েছে মিশরও। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, গাজার বেসামরিক নাগরিকদের ওপর এভাবে নির্বিচার হামলা ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের চরম লঙ্ঘন’।
বাইডেনের সঙ্গে আরব নেতাদের বৈঠক বাতিল!
গাজা উপত্যকায় হাসপাতালে ইসরায়েলের বোমা হামলার জেরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেছেন আরব নেতারা। বৈঠকটি বুধবার জর্ডানের রাজধানী আম্মানে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। বার্তা সংস্থা এপির প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সঙ্গে চলমান সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে মিত্র ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জানানোর অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও শীর্ষ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের পর এবার তেল আবিব সফরে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ইসরায়েল সফর শেষে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে যাওয়ার কথা ছিল বাইডেনের। সেখানে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ও ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে বৈঠকের কথা ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্টের। তবে জর্ডান জানিয়ে দিয়েছে, বাইডেনের সঙ্গে তিন আরব নেতার যে নির্ধারিত বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, তা আর হচ্ছে না। গাজার হাসপাতালে হামলার প্রতিবাদে জর্ডান বাইডেনের সঙ্গে নির্ধারিত এ বৈঠক বাতিল করেছে। বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক বাতিলের ঘোষণা দিয়ে জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেন, ‘যুদ্ধ বন্ধ করা ছাড়া এখন আর আলোচনা করে কোনো লাভ নেই।’ অবশ্য জর্ডানের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার আগেই বাইডেনের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিলের ঘোষণা দেন ফিলিস্তিনির প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। আল–আহলি আরব হাসপাতালে ইসরায়েলের হামলায় হতাহতের ঘটনায় বাইডেন দুঃখপ্রকাশ করেছেন বলে জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এএফপি।
গাজায় যুদ্ধের দায়ভার যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের: হামাস
গাজায় বেসামরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলকে সমর্থনকারী পশ্চিমা দেশগুলোকে দায়ী করেছে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন হামাস। আজ বুধবার (১৮ অক্টোবর) আল-জাজিরার প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। লেবাননে এক সংবাদ সম্মেলনে হামাস কর্মকর্তা ওসামা হামদান বলেন, গাজায় বেসামরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সম্পূর্ণ দায়ভার যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলকে সমর্থনকারী পশ্চিমা দেশগুলোকে বহন করতে হবে। ওসামা হামদান অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় মানবিক করিডোর চালু এবং গাজার আল-আহলি হাসপাতালে মঙ্গলবার রাতের বিস্ফোরণের পর আঞ্চলিক বিক্ষোভ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।
ইসরাইলের বিরুদ্ধে একযোগে অবরোধ আরোপের আহ্বান ইরানের
ইসরাইলের বিরুদ্ধে সম্মিলিত অবরোধ আরোপ করতে মুসলিম বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইরান। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান বুধবার ওআইসি বৈঠকে এ আহ্বান জানান। পাশাপাশি যেসব মুসলিম দেশে ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত রয়েছে তাদেরকে বহিষ্কারের দাবিও তোলেন তিনি। এ খবর দিয়েছে আরব নিউজ। খবরে জানানো হয়, সৌদি আরবের জেদ্দাহ শহরে ইসরাইল-ফিলিস্তিন চলমান সংঘাত নিয়ে জরুরি ওই বৈঠক ডাকে ওআইসি। গাজার হাসপাতালে ইসরাইলের একটি মিসাইল হামলায় পাঁচ শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার পরদিনই বৈঠকে বসেন মুসলিম দেশগুলোর প্রতিনিধিরা। ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, ওআইসি বৈঠকে অংশ নেয়া দেশগুলোকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সম্মিলিত অবরোধ আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এছাড়া ইসরাইল গাজায় যে যুদ্ধাপরাধ চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালাতে ইসলামিক দেশগুলোকে আইনজীবীদের একটি দল গঠনের প্রস্তাব দেন তিনি। গাজার হাসপাতালে ইসরাইলি হামলার পর রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে ইরান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম রায়িসি বলেন, গাজার হাসপাতালে আহত ও নিপীড়িত মানুষের ওপর যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইলের তৈরি যে বোমা ফেলা হয়েছে তার আগুন দ্রুতই তাদেরকে গ্রাস করবে। এই যুদ্ধাপরাধের মুখে কোনো আদর্শবান ব্যক্তি নীরব থাকতে পারে না।