ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে ফের নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে ডলারের বাজার। ব্যাংক কিংবা মানিচেঞ্জার কোথাও ঘোষিত মূল্যে ডলার বিক্রি হচ্ছে না। ব্যাংকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খোলাবাজারে ডলারের দরে একের পর এক রেকর্ড হচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার একদিনের ব্যবধানে খোলাবাজারে ডলারের দর আড়াই টাকা বেড়ে ১২৬ টাকা ৫০ পয়সায় উঠেছে, যা এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ। আগের দিন বুধবার এ বাজারে ডলারের দর ছিল ১২৩ থেকে ১২৪ টাকা।
এমনিতেই ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীদের আমদানি বিল নিষ্পত্তিতে হিমশিম খাচ্ছে অনেক ব্যাংক। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো হঠাৎ করে ১২ থেকে ১৪ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে রেমিট্যান্সে ডলারের দাম। ফলে রেমিট্যান্স সংগ্রহে ব্যাংকের দর উঠেছে ১২২ থেকে ১২৪ টাকা। আর রেমিট্যান্স কেনায় খরচ বাড়ায় গত দুদিনে আমদানিতেও ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। এখন আমদানিকারকদের প্রতি ডলারের জন্য গুনতে হচ্ছে ১২২ থেকে ১২৫ টাকা।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকগুলো বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ১২২ থেকে ১২৪ টাকা দরে ডলার কেনার বিষয়টি জানাজানির পর খোলাবাজারেও নগদ ডলারের দর দ্রুত বাড়ছে। যদিও নির্ধারিত দাম অনুযায়ী খোলাবাজারে ডলারের দাম ১১৩ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। গত সপ্তাহে খোলাবাজারে প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকার নিচে ছিল। এর আগে গত বছরের আগস্টে সর্বোচ্চ ১২০ টাকা উঠেছিল ডলারের দাম।
দেশে গত দেড় বছর ধরে চলছে ডলার সংকট। সংকট সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ডলার
দাম নির্ধারণ করে দেওয়া দুই সংগঠন বাফেদা ও এবিবি। শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণ করত। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এই দুই সংগঠন ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করছে। তবুও সংকট কাটছে না। উল্টো ডলার বাজারের পরিস্থিতিতে আরও জটিলতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে বারবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হচ্ছে। মূলত ডলারের দাম নির্ধারণ নিয়ে সমন্বয়হীনতার কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আসলে রেট নির্ধারণ করে দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। এটা থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হয়ে আসা উচিত। বাজারে প্রতিযোগিতা তৈরি ও স্বচ্ছতা বাড়াতে আগের মতো বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় ফেরত যেতে হবে। তা ছাড়া নিয়ন্ত্রণ করে রেখেও বাজারের অস্থিরতা কমানো গেছে এমনটিও নয়। বরং এর মাধ্যমে অনেক ধরনের ম্যানুপুলেশন এবং দেনদরবার করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
গত ৩১ অক্টোবর এবিবি ও বাফেদার মধ্যে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের ডলার কিনবে। আর আন্তঃব্যাংক ও আমদানিতে সর্বোচ্চ ১১১ টাকায় ডলার বিক্রি করতে হবে। এ ছাড়া গত ২০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সভায় নেওয়া রেমিট্যান্স সংগ্রহে আড়াই শতাংশ প্রণোদনার সীমা তুলে দিয়ে নিজেদের মতো করে প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অবশ্য এসব প্রণোদনার টাকা ব্যাংকের নিজেদের পরিশোধ করতে হবে, গ্রাহকদের কাছে থেকে এই বাড়তি দাম নেওয়া যাবে না। এই সুযোগেই ব্যাংকগুলো ১২২ থেকে ১২৪ টাকা দামে প্রবাসী আয় কিনছে। যেসব ব্যাংকের আমদানি দায় মেটানোর চাপ আছে, তারা এই দামে ডলার কিনে দায় মেটাচ্ছে। এতে আমদানিতে ডলারের দাম এক ধাক্কায় ১২-১৫ টাকা বেড়ে ১২৫ টাকায় ওঠে।
এই খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর গত বুধবার জরুরি সভা করে এবিবি ও বাফেদা। সেখানে ৩১ অক্টোবরের সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে পালন করার তাগিদ দেওয়া হয়। আর প্রবাসী আয়ে ব্যাংকের নিজস্ব ও সরকারের প্রণোদনাসহ ডলারের দর কোনোভাবেই ১১৬ টাকার বেশি দেওয়া যাবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়। এরপর গতকাল বৃহস্পতিবার এই দুই সংগঠনের ২১ প্রতিনিধির (২১ ব্যাংকের এমডি) সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। মূলত ডলারসংক্রান্ত নির্দেশনা ঠিকমতো বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয় সংগঠন দুটি। এতে তাদের আশ্বস্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বৈঠক শেষে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ এবিবির চেয়ারম্যান এবং ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। এই সমস্যা সমাধানে আমাদের সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে। আমাদের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো ব্যাংক চাইলে ১১৬ টাকা পর্যন্ত রেমিট্যান্স কিনতে পারবে। কিন্তু ১১১ টাকার বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে না। তারপরও যারা নির্দেশনা ভঙ্গ করছেন তাদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। আমরা একত্রে বাজারটাকে স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে আসব। আমদানিকারকরা নির্ধারিত দামের ডলার পাচ্ছে না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যদি কোনো আমদানিকারকের এ রকম অভিযোগ থাকে, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এসে জানাতে হবে। তা ছাড়া সব বিষয়ে লাইন বাই লাইন লিখিতভাবে নির্দেশনা দেওয়া যায় না বলেও মনে করেন এই ব্যাংকার।
বৈঠকের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, সংগঠন দুটির মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্ত ঠিকমতো বাস্তবায়নের জন্য সাহায্য চাইতে এসেছিলেন তারা। আমরাও জানিয়েছি সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে। নির্দেশনার বাইরে কোনো ব্যাংক অথবা এক্সচেঞ্জ হাউস ডলার কেনাবেচা করলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
খোলাবাজারে ডলারের দামে রেকর্ড : খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেশির ভাগ মানিচেঞ্জারের কাছে ডলার নেই। যাদের কাছে আছে তারাও সরাসরি ডলার বিক্রি করছে না। পরিচিত কারও মাধ্যমে ডলার বিক্রি করছেন। এ বিষয়ে রাজধানীর দিলকুশায় অবস্থিত মানি এক্সচেঞ্জ হাউসের একাধিক বিক্রেতা আমাদের সময়কে জানান, ডলারের অনেক সংকট। এক দিনে রেট বেড়েছে আড়াই টাকা। এর আগের দিন ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছিল। আজকে (গতকাল) কোনো গ্রাহক ডলার বিক্রি করতে এলে রেট দিয়েছি ১২৪ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১২৫ টাকা ৫০ পয়সা। আর যারা কিনেছে তাদের কাছ থেকে নিয়েছি প্রতি ডলার ১২৫ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১২৬.৫০ টাকা।
রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত : ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছর এরই মধ্যে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের মতো বিক্রি করা হয়েছে। গত অর্থবছর বিক্রি করা হয় ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। এর আগের অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়।