বাংলাদেশ নিউজ ডেস্ক: জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং একাদশ জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ গতকাল রবিবার রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনী তফসিলের সময় পেছানোর অনুরোধ জানিয়েছেন। জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুও এ দিন বলেছেন, নির্বাচনের জন্য যে পরিবেশ দরকার, সেই পরিবেশ এখনো হয়নি। সংবিধানের আলোকে একটি উপায় বের করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এদিকে বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, এখনো সময় আছে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তদারকি সরকার গঠন করা হোক এবং তফসিল পুনর্নির্ধারণ করা হোক। অন্যথা এই ভোটে বামপন্থিরা অংশ নেবে না। অন্যদিকে ঘোষিত তফসিল প্রত্যাখ্যান করে রাজনীতির মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ সুশীল সমাজ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন মহল থেকে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে বরাবরই তাগিদ দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীরও গতকাল বলেছেন, বিএনপি যদি নির্বাচন করতে চায় এবং আমাদের সহায়তা চায়, আমরা সহায়তা করব। এতসব কারণে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে- ভোটের তারিখে পরিবর্তন আসতেও পারে। বলা হচ্ছে, বিএনপি অংশ নিলে ভোটের দিনক্ষণ শেষপর্যন্ত পিছিয়ে যেতে পারে।
সব রাজনৈতিক দলকে ভোটে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে ঘোষিত তফসিল বর্জন করে চলছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর আন্দোলন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, একাদশ সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ বেশ কয়েকটি দল ভোটে অংশগ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেছে।
বড় দুপক্ষের পরস্পরবিরোধী এমন অবস্থানের কারণে ভোটের মাঠ এখনো প্রত্যাশিত সরগরম হয়নি। এরই মধ্যে গতকাল রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আলোচনার উদ্যোগ ও মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় বাড়িয়ে তারিখ পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। গতকাল দুপুরে তিনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সংবিধানের বাধ্যবাধকতা রক্ষা, নির্বাচনী তফসিলের সময় পেছানোসহ ৫টি প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আপনি রাষ্ট্রের অভিভাবক। সেই বিবেচনাতেও আপনি সব রাজনৈতিক দলকে আলোচনার জন্য আহ্বান জানাতে পারেন। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী আলাপ-আলোচনা শেষে বঙ্গভবন ত্যাগ করেন রওশন এরশাদ। এ সময় বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা, সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ রওশন আরা মান্নান, এরশাদপুত্র রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদ এবং কাজী মো. মামুনূর রশিদ ছিলেন রওশন এরশাদের সঙ্গে।
বৈঠক শেষে মসিউর রহমান রাঙ্গা জানান, রাষ্ট্রপতির কাছে রওশন এরশাদ মনোনয়নপত্র জমার সময়কাল আরও পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। ৩০ নভেম্বর আয়কর রিটার্ন ও মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। এ ক্ষেত্রে মনোনয়নপত্র জমাদানের সময়কাল দু-এক দিন পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছেন তিনি।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আমরা বলেছি, যে দলীয় সরকারের অধীনে তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে তা অব্যাহত থাকা মানে একতরফা ও প্রহসনের নির্বাচন হবে; ভুয়া নির্বাচন হবে- যা গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণে আমরা বলেছি, এখনো সময় আছে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তদারকি সরকার গঠন করা হোক এবং তফসিল পুনর্নির্ধারণ করা হোক। তাহলে হয়তো আমরা ভোটের বিষয়ে আলোচনা করতে পারব। অন্যথায় এই তফসিলের এই ভোটে বামপন্থিরা অংশ নেবে না।
জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সব প্রস্তুতি জাপার আছে। আমরা এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে চাই। আমরা জোট, মহাজোট ইত্যাদি করতে চাই না। যে দল বেশি আসন পাবে সেই দল সরকার গঠন করবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা নির্বাচনে যাব কিন্তু দল থেকে এখনো সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। তবে আমাদের সব প্রস্তুতি নেওয়া আছে। বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম দল জাতীয় পার্টি থেকে বারবার বলা হয়েছে, নির্বাচনের একটি সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। মানুষ স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে- এমন আস্থা যদি মানুষের না থাকে, তাহলে নির্বাচনে কীভাবে যাব?
তিনি আরও বলেন, সরকার পদত্যাগ করে চলে যাক এটা চাই না। আবার সরকারকে বাধ্য করব এটাও চাই না। আমরা একটি মাঝামাঝি পথ চাই। সংবিধানের আলোকে একটি ওয়ে (উপায়) বের করা যেন সবাই নির্বাচনে আসে। নির্বাচনের একটি পরিবেশ দরকার, সেই পরিবেশ এখনো হয়নি।
নির্বাচনী পরিবেশের বিষয়টিকে আওয়ামী লীগ কীভাবে দেখছে তা জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য আবদুর রহমান বলেন, তফসিল ঘোষণার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের। তা যথাসময়ে কার্যকর করার দায়িত্বও তাদের। একটা অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। দল হিসেবে আমরা মনে করি, ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচন হবে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর গতকাল রবিবার বলেছেন, বিএনপি যদি বলে আমরা নির্বাচন করবো, আমাদের সহায়তা করেন। তাহলে অবশ্যই আমরা সহায়তা করব। তবে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব আমাদের না। যেসব দল নির্বাচনে অংশ নেবে, তাদের জন্য যতরকম চেষ্টা করা যায়, তা করা হবে। যারা নির্বাচনে আসবে না, তাদের ব্যাপারে আমাদের কিছু করার নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে কোনো অভিযোগ পেলে এবং তা প্রমাণ হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে অভিযোগ সুনির্দিষ্ট ও তথ্যবহুল হতে হবে।
কয়েকটি দলের অভিযোগ, নির্বাচনের পরিবেশ নেই। এ প্রসঙ্গ তোলা হলে মো. আলমগীর বলেন, চিরকাল সরকারি দল এবং বিরোধী দল পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। এটা ১৯৭০ সাল থেকেই দেখে আসছি।
গত ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। সে সময় তিনি বলেন, সংঘাত পরিহার করে সমাধান অন্বেষণ করুন। সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয়।
নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো ঘোষিত এই তফসিল প্রত্যাখ্যান করে। তাৎক্ষণিক রাজধানীতে এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে বাম গণতান্ত্রিক জোট ও গণতন্ত্র মঞ্চ। তফসিল প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দেয় বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট। অপরদিকে তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে আনন্দ মিছিল করেছে আওয়ামী লীগ, স্বাগত জানিয়েছে সমমনা শরিক দলগুলো।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে ১৭টি দলই ঘোষিত তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে; স্বাগত জানিয়েছে ১৫টি দল। অবশিষ্ট ১২টি দল এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। এমন পরিস্থিতিতে সব দলের অংশগ্রহণের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানিয়েছেন রওশন এরশাদ।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। এর মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৯ জানুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী, এর আগে ৯০ দিনের মধ্যে ভোট হতে হবে। সেই হিসাবে গত ১ নভেম্বর থেকে নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হয়ে গেছে। ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা আছে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ করা হবে আগামী ৭ জানুয়ারি। নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর। মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর। প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার তারিখ পেছালে বাছাইয়ের তারিখসহ সব তারিখ পেছাতে হবে। ভোটগ্রহণের তারিখেও পরিবর্তন আসতে পারে। ইসির হাতে সেই সময়ও আছে। প্রসঙ্গত, একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময়ও পুনঃতফসিলের মাধ্যমে ভোটের তারিখ পেছানো হয়েছিল।