- সংঘাতে জনশূন্য নাইক্ষ্যংছড়ির ৭ গ্রাম
- ৩৬৭ সেনা বিজিপি পালিয়ে বাংলাদেশে
- পালিয়ে আসছেন মিয়ানমারের সেনা সদস্যও
- মিয়ানমার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চান বাংলাদেশ দূত
আরাকান নিউজ ডেস্ক: মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে আরাকার রাজ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) তুমুল লড়াই চলছে। অনবরত গোলাগুলিতে হচ্ছে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা। দুই পক্ষের চলমান সংঘাতে উত্তপ্ত বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকাও। মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টারশেল গতকালও বাংলাদেশে এসে পড়েছে। এতে আতঙ্ক বিরাজ করছে সীমান্ত এলাকার মানুষের মধ্যে। এমন পরিস্থিতিতে নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বান্দরবান জেলা প্রশাসন। দুই পক্ষের চলমান সংঘাতে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে ৩৬৭ সৈন্য। এ ছাড়াও ২৩ জন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যও অনুপ্রবেশের সময় আটক হয়েছেন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেছেন, সীমান্ত এলাকা বিজিবি’র নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যারা অনুপ্রবেশ করেছে তাদের পুশব্যাকের চেষ্টা চলছে।
নতুন করে কোনো রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়া হবে না। অন্যদিকে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টারশেল ও গুলি বাংলাদেশে পড়া এবং দুইজন নিহতের ঘটনায় ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, তার ভারত সফরে মিয়ানমারের চলমান সংঘাত ও সীমান্ত ইস্যুতে আলোচনা হবে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আমরা কারও সঙ্গে যুদ্ধ চাই না। যেকোনো সমস্যা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আমাদের সিদ্ধান্ত আছে। থাইল্যান্ডভিত্তিক মিয়ানমারের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ইরাবতির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইনের ম্রাউক ইউ ও কিয়াকতাও শহরে জান্তা বাহিনীর আরও দুটি ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর দখলে নেয়ার দাবি করেছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)। গোষ্ঠীটি বলেছে, সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর দখলের অভিযানের সময় ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে মিয়ানমার জান্তার অনেক সৈন্য হতাহত হয়েছে। আরাকান আর্মির দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তিনটি ব্যাটালিয়ন ম্রাউক ইউ শহরের ঐতিহাসিক রাজধানী, ম্রাউক ইউ প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর, শহরের আবাসিক এলাকা এবং আশপাশের গ্রামগুলোতে গোলাবর্ষণ করেছে। আকাশ ও সমুদ্র থেকে জান্তা বাহিনীর বোমাবর্ষণের মাঝেই রাথেডং, পোন্নাগিউন, রামরি এবং অ্যান শহরে সংঘর্ষ চলছে। মংডু শহরের বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া টাং পিয়ো সীমান্ত ফাঁড়িতে হামলা চালিয়েছে আরাকান আর্মি।
এদিকে সীমান্তের ওপারে চলমান সংঘাতে আতঙ্ক বিরাজ করছে সীমান্ত এলাকার মানুষের মধ্যে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী, বাজার পাড়া এলাকার মানুষ আতঙ্কে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। ফাঁকা পড়ে আছে তুমব্রু বাজার, বেতবুনিয়া বাজার স্কুল ও মাদ্রাসা। গত সোমবার রাত ৯টা থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত অনবরত গোলাগুলির শব্দে আতঙ্কে ভয়ের মধ্যে রাত কাটিয়েছে নাইক্ষ্যংছড়ি ও ঘুমধুমের বাসিন্দারা। এতে কেঁপে ওঠে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার অন্তত ৭টি গ্রাম। ভয় ও আতঙ্কে প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ঘুমধুম ইউনিয়নের সাতটি গ্রাম। উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সোমবার রাত থেকে এ পর্যন্ত সেখানে সাতটি পাড়ার ৪০টি পরিবারের শতাধিক লোক আশ্রয় নিয়েছেন। এদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ২৪০ পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক (ডিসি)।
অন্যদিকে সীমান্তের ওপারে চলমান সংঘাতের প্রভাব পড়েছে কক্সবাজারের টেকনাফেও। দুই পক্ষের গুলি ও মর্টারশেল উড়ে এসে পড়ছে এখানে। এতে আতঙ্ক বিরাজ করছে এ এলাকার মানুষের মধ্যে। ওদিকে চলমান সংঘাতে এ পর্যন্ত দেশটির ২৬৪ সৈন্য বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। যেখানে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি), মিয়ানমার সেনাবাহিনী, ইমিগ্রেশন সদস্য, পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার সদস্য রয়েছে। যাতে বিজিপি’র কমান্ডারও রয়েছে। এ ছাড়াও বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর ২৩ সদস্যকেও আটক করেছে স্থানীয়রা। কক্সবাজারের উখিয়ার সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকালে তাদের আটক করা হয়। পরে তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর চৌধুরী বলেন, সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে চলমান সংঘর্ষের কারণে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আশ্রয় নিতে আসছিল। এ সময় তাদের দেখতে পেয়ে স্থানীয়রা জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাদের লক্ষ্য করে বোমা হামলা করে। এতে কয়েকজন স্থানীয় আহত হয়েছেন। পরে স্থানীয়রা ধাওয়া করে তাদের আটক করেন। তাদের পুলিশের হেফাজতে দেয়া হয়েছে।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির পর সেনাবাহিনী, পুলিশ, কাস্টমস ও বেসামরিক ব্যক্তিরাও প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। পালিয়ে বাংলাদেশে আসছেন মিয়ানমারের সেনা সদস্যও। সীমান্ত পরিস্থিতির বিষয়ে প্রতিবাদ জানাতে ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিয়াও মোকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরপর মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র জানান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের মহাপরিচালক মিয়া মো. মইনুল কবির রাখাইন রাজ্যের সহিংসতা সীমান্তের এপারে বাংলাদেশে এসে পড়ায়, বিশেষত ওই সহিংসতায় কক্সবাজারে দুজনের মৃত্যু ঘটার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রদূতকে একটি কড়া প্রতিবাদ বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রকে বলা হয়েছে, সীমান্তে যা ঘটছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এদিকে সীমান্তে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির অবসানে মিয়ানমারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী থান শোয়ের সাক্ষাৎ চেয়েছেন ইয়াঙ্গুনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. মো. মনোয়ার হোসেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের নদী পথে ফিরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব করেছে নেপি’ড। কিন্তু ঢাকা মনে করে আরাকানে দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল লড়াই অব্যাহত থাকায় নদী পথটি ঝুঁকিমুক্ত নয়। এ অবস্থায় নৌপথের পরিবর্তে আকাশপথে মিয়ানমারের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার বিকল্প প্রস্তাব রেখেছে বাংলাদেশ। যদিও নিজ দেশের অবস্থা পর্যালোচনায় এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মিয়ানমারই নেবে, তথাপি আগবাড়িয়ে বাংলাদেশের এমন প্রস্তাব কতটা যৌক্তিক? তা নিয়ে নেটিজেনরা এরইমধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন।