আরাকান নিউজ ডেস্ক: মিয়ানমারে গৃহ অশান্তির মধ্যেই ভারতে বসবাসকারী সে দেশের শরণার্থীদের স্বদেশে ফেরানোর কাজ শুরু করল ভারত। শনিবার মণিপুরের মোরে সীমান্ত দিয়ে প্রায় ৭০জনকে ফেরানো হবে।
মিয়ানমারের এই নাগরিকেরা ২০২১ সাল থেকে মণিপুরের আশ্রয় শিবিরে ছিলেন। সে বছর ওই দেশে সেনা ফের ক্ষমতা দখল করার পর মিলিটারির অত্যাচারের মুখে দেশ ছাড়েন মিয়ানমারের বহু মানুষ।
সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ অশান্তির মুখে ভারতের শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। নয়াদিল্লি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে, পড়শি দেশের অভ্যন্তরীণ অচলাবস্থার কারণে শরণার্থীদের ব্যাপারে ভারত মোটেই মানবিক অবস্থান নেবে না।
মণিপুর ছাড়াও মিজোরাম এবং নাগাল্যান্ডেও মিয়ানমারের বহু নাগরিক আশ্রয় শিবির রয়েছেন। তাদেরও পর্যায়ক্রমে ফেরত পাঠানো হবে।
অন্যদিকে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নিয়ে পড়শি দেশ বাংলাদেশের সমস্যা ক্রমেই ঘনিভূত হচ্ছে। মিয়ানমারে এখন সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির লড়াই চলছে। দেশটির অর্ধেকের বেশি এলাকা বিদ্রোহীদের দখলে। এর প্রভাব বাংলাদেশের কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে পড়েছে। এমনীতেই সেখানে ২০১৭ থেকে পনেরো লাখ রোহিঙ্গার ভরনপোষণের খরচ সামাল দিতে হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারকে। করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতির ত্রাণ আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে সব দায় গিয়ে পড়েছে আশ্রয়দাতা সরকারের উপর।
তার উপর ক্যাম্প থেকে বহু রোহিঙ্গা যুবক মায়ানমারে গিয়ে আরাকান ন্যাশনাল আর্মির কাছে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছে। তারা রাখাইন প্রদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার লক্ষ্য নিয়ে এগচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার চিন্তিত সামরিক প্রশিক্ষণ পাওয়া রোহিঙ্গা যুবকেরা ফের কক্সবাজারের আশ্রয় শিবিরে ফিরে এলে সেখানকার আইন-শৃঙ্খলার আরও অবনতি হবে। এমনীতেই সেখানে খুনখারাবি, মাদক ও মানব পাচারের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের দিশেহারা অবস্থা।
আবার মিয়ানমারের সেনা শাসকেরাও দেশের রাখাইন প্রদেশ থেকে রোহিঙ্গা যুবকদের ধরে নিয়ে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ পাওয়া ওই রোহিঙ্গা যুবকেরাও সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে, আশঙ্কা ঢাকার।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মিয়ানমার সীমান্তে প্রহরা বাবদ খরচ অনেক বেড়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের আর্জি জানিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মামুদ দায়িত্ব নিয়েই ভারত সফরে এসে বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর এবং নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত কুমার দোভালের সঙ্গে বৈঠকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে নয়াদিল্লিকে পাশে চেয়েছেন।
সূত্রের খবর, ভারত আগের অবস্থান বদলে এই ইস্যুতে এখন ঢাকার পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে। কারণ, মিয়ানমার পরিস্থিতি ভারতের নিরাপত্তার পক্ষেও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে চলেছে বলে নয়াদিল্লির নিরাপত্তা উপদেষ্টারাও মনে করছেন। সেই কারণে শরণার্থীদের ব্যাপারে ভারত এখন থেকেই কঠোর অবস্থান নিচ্ছে। দেশের স্বার্থেই নয়াদিল্লি মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলিতে সমর্থন করার পক্ষপাতী নয়। মিয়ানমারের অশান্তি যত বাড়বে তার প্রভাব ততই বাড়বে ভারত ও বাংলাদেশের উপর।
মিয়ানমারের অশান্ত পরিস্থিতির মধ্যে নয়াদিল্লির কর্তারা কেন সে দেশের শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে মরিয়া হয়ে উঠলেন, কূটনৈতিক মহলে তা নিয়ে জোর চর্চা শুরু হয়েছে। শুধু শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোই নয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, ভারত ও মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত বিনা ভিসায় যাতায়াতের যে ব্যবস্থা চালু আছে তা প্রত্যাহার করে গোটা সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দেওয়া হবে।
আসলে মণিপুরের জাতিদাঙ্গার পর মিয়ানমার নিয়ে ভারত সরকারের চিন্তা বেড়েছে। কারণ, মণিপুরের কুকি, মিজোরামের জো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মায়ানমার চিন প্রদেশের মানুষের নৃতাত্ত্বিক সম্পর্ক রয়েছে। তারা নিজেদের একই জো জনগোষ্ঠীর অংশ বলে মনে করে। ফলে মিয়ানমারে যে কোনও অশান্তির ঘটনায় সে দেশের নাগরিকদের মণিপুর, মিজোরামের বাসিন্দারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এখন মিয়ানমারের যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে যে কোনও সময় দেশটি দু-তিন টুকরো হয়ে যেতে পারে। তখন শরণার্থী স্রোত বাড়তে পারে ভারতের উপর।
নয়াদিল্লির পররাষ্ট্রমন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, ভারত ১৯৫১ সালের আন্তর্জাতিক শরণার্থী সনদের স্বাক্ষরকারী নয়। তা সত্ত্বেও মিয়ানমারের নাগরিকদের মানবিক কারণে এতদিন আশ্রয় দিয়েছে। এখন তাদের জন্য দরজা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে ভূ-রাজনৈতিক কারণে। গোটা ভাবনার সঙ্গে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত।