সাংবাদিকতায় পাঁচ দশকের বেশি সময়ের বিচরণ। কূটনীতির অন্দরমহল থেকে রাজনীতির মাঠ। বিশ্বকাপ ফুটবল থেকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। মাঠের দাপুটে রিপোর্টার থেকে বলিষ্ঠ সম্পাদক। মতিউর রহমান চৌধুরী। মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক। এক সাক্ষাৎকারে খোলামেলা কথা বলেছেন মূলত সাংবাদিকতা নিয়ে। বলেছেন, দেশে অনেক মিডিয়া, সাংবাদিক, কিন্তু সাংবাদিকতা কোথায়? সাংবাদিকের বিবেক, কলম, কম্পিউটার, কি-বোর্ডকে নিরপেক্ষ রাখতে হবে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- জয়শ্রী ভাদুড়ী ও শরিফুল ইসলাম সীমান্ত।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও সংবাদমাধ্যম বর্তমানে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে?
মতিউর রহমান চৌধুরী : প্রচুর পত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেল। অসংখ্য অনলাইন। শুধু ঢাকা থেকেই প্রকাশিত হয় কয়েক শ পত্রিকা। প্রায় প্রতিদিনই নতুন পত্রিকা বের হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকবে, তাই বলে প্রতিদিনই একটি করে নতুন পত্রিকার অনুমোদন দেওয়ার কোনো মানে হয় না। পত্রিকাগুলোর দায়িত্ব কাকে দেওয়া হচ্ছে সেটিও একটি প্রশ্ন। দেখা যায় এমন মানুষদের পত্রিকার লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে যারা কখনোই সাংবাদিকতা কিংবা গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। সরকার বলছে যে, শত শত কাগজ বের হচ্ছে, স্বাধীনতা না থাকলে তো এত কাগজ বের হতে পারে না। কিন্তু বেশি বেশি সংবাদপত্র বের হলেই গণমাধ্যম স্বাধীন এটি বলার সুযোগ নেই। অনেক মিডিয়া, সাংবাদিক, কিন্তু সাংবাদিকতা কোথায়? কারা সাংবাদিক হবে তার কোনো সংজ্ঞাও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। কারা সংবাদপত্র বের করতে পারবে আর কারা পারবে না সেটিরও কোনো মাপকাঠি নেই।
প্রশ্ন : অতীতের সঙ্গে তুলনা করলে পরিস্থিতি কেমন?
মতিউর রহমান চৌধুরী : সাংবাদিকতার মান ক্রমাগত নিম্নমুখী। প্রতিযোগিতা নেই। এখন হলো চাকরি। আমার দল। দলকে খুশি রাখব এই হলো লক্ষ্য। আমরা যখন সাংবাদিকতা পেশায় আসি তখন দুই ধরনের সাংবাদিকতা ছিল। একটি হলো রাজনৈতিক সাংবাদিকতা, আরেকটি হলো প্রকৃত সাংবাদিকতা। এ দুটির মধ্যে প্রচুর লড়াই হয়েছে। কিন্তু দিনশেষে যারা সত্যিকার অর্থে সাংবাদিকতা করতে চান তারাই টিকেছেন। পৃথিবী কিন্তু বদলে যাচ্ছে। সেই অনুযায়ী আমরা বদলাইনি। নিউজের ধারা বদলাইনি। আমরা চিন্তা করি, কোন নিউজে সরকার খুশি, আর কোন নিউজে অখুশি হবে। আর কোন নিউজে অখুশি হবে বিরোধী দল। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী এদের মাথায়ও রাজনীতি ছিল, কিন্তু তাদের মুখে সেটি প্রকাশ পেত না। এখন তো টেলিভিশনের পর্দায় দেখলেই আমরা বলে উঠি, ও আচ্ছা উনি তো এই দলের, উনি তো ওই দলের। এগুলো থেকে যদি আমরা মুক্ত হতে না পারি তবে সাংবাদিকতা চ্যালেঞ্জের মুখেই থাকবে।
প্রশ্ন : গণমাধ্যমে বর্তমানে যেসব কনটেন্ট প্রকাশিত হয় সে ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী?
মতিউর রহমান চৌধুরী : খুব অল্পসংখ্যক কাগজে ভালো প্রতিবেদন ছাপা হয়, চমৎকার এডিট হয়। অনেক অফিসে এডিট করার যোগ্য লোকও নেই, সময়ও নেই। এর ফলে প্রতিবেদনের মান নিচের দিকে যাচ্ছে। অনলাইন থেকে কপি করার অভ্যাস আমাদের সৃজনশীলতাকে খেয়ে ফেলছে। নকলের যে অভ্যাস সেখান থেকে আমরা বের হতে পারছি না। কারণ আমাদের লোকবল কম। দেখা যায়, তিনজন লোক মিলে একটি অনলাইন পোর্টাল চালাচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে প্রতিবেদনের মান আরও খারাপের দিকে যাবে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের আইনি কাঠামো কতটা গণমাধ্যমবান্ধব? গণমাধ্যমে এক ধরনের সেলফ সেন্সরশিপ চলছে বলে অভিযোগ আছে।
মতিউর রহমান চৌধুরী : নীতিমালা হয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য, বিকাশের জন্য হয় না। বিকাশের জন্য করা হলে ওই নীতিনির্ধারণী মহলে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত কেউ থাকত। যুক্ত না এ কারণে যে, তারা যুক্ত করেন না। বর্তমানে সাংবাদিকদের মাথায় রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা একটু বেশি পরিমাণে ঢুকে পড়েছে। আমরা যখন যুদ্ধ-পরবর্তী দেশে সাংবাদিকতায় আসি, তখনো আমাদের মাথায় রাজনীতি ছিল। আমাদের তখন ডেকে আনা হয়েছিল গণমাধ্যমে কাজ করার জন্য। এটিও স্বীকার করতে হবে যে, রাজনীতি না থাকলে সাংবাদিকতা হয় না। কিন্তু সাংবাদিকদের প্রকাশ্য রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া যাবে না। রাজনীতি থাকবে পেটে আর কলম থাকবে নিরপেক্ষ। এই পার্থক্যটুকু আমরা করি না। আমরা দুটিকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলি। যে কারণে আমরা কিছু শিখতে পারছি না, দিতেও পারছি না। আমাদের সাংবাদিকদের কিন্তু দেওয়ার অনেক কিছু আছে।
সাংবাদিকদের বেতনের পরিমাণ টাকা ঢাকা শহরে আলু-পটোলের ব্যবসা করেও রোজগার করা যায়। তারপরও মানুষ সাংবাদিকতায় আসে। কারণ এই পেশা থেকে জাতির ভাগ্যোন্নয়নে কিছুটা হলেও অবদান রাখা যায়। যারা প্রকৃত অর্থে মানুষকে কিছু দেওয়ার জন্য সাংবাদিকতায় আসে স্বাভাবিকভাবে হতাশার শিকার হন। খুঁজলে দেখা যাবে এমনও সাংবাদিক আছেন, যারা সম্পাদকের চাইতেও দামি গাড়িতে চলাফেরা করেন। হ্যাঁ, সাংবাদিকতা করলে আপনি ধনী হতেই পারেন, এটি অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু আয়টা যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। নানা আইনকানুনে সাংবাদিকদের হাত-পা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। এর ওপর আবার আমরা সাংবাদিকরা নিজেরাই সেলফ সেন্সরশিপ করছি। এসব কারণ সাংবাদিকতাকে ধ্বংস করে ফেলছে। এসব কিছু থেকে আমরা যদি মুক্তি না পাই তবে একটা পর্যায়ে গিয়ে দেশীয় সংবাদমাধ্যম থেমে যাবে, পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। সেলফ সেন্সরশিপ কিন্তু ভয়ভীতি থেকে গড়ে উঠছে না। এটিকে আমি আমাদের প্রাপ্ত শাস্তি বলে বিবেচনা করতে চাই। আমার সামনে অমুক সাংবাদিক সেলফ সেন্সরশিপ চালিয়ে ভালো থাকছে, তাহলে আমি কেন থাকব না- এমন প্রবণতাই আমাদের সেলফ সেন্সরশিপের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
প্রশ্ন : সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মতিউর রহমান চৌধুরী : ইদানীং তাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। কিন্তু সংখ্যা বাড়লেই যে কাগজের মান ভালো হয়ে যাবে সেটি নয়। হতাশার বিষয় হচ্ছে, সাংবাদিকতার পড়াশোনা শেষ করে পুঁথিগত বিদ্যার সঙ্গে বাস্তব সাংবাদিকতার মিল তারা খুঁজে পায় না। ফলে সাংবাদিকতায় যোগ দিয়ে তাদের ঝরে পড়ার সংখ্যাও কম নয়। তাদের সিলেবাস বাংলাদেশি সাংবাদিকতার উপযোগী নয়। উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই, আমার বন্ধু চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের কথা। এখনো পর্যন্ত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সিলেবাসে তার কোনো বই আমি দেখিনি। অথচ হাজার চেষ্টা করলেও আরেকটা মোনাজাতউদ্দিন বাংলাদেশে তৈরি করা সম্ভব নয়। মোনাজাতউদ্দিন এই সমাজ, এই জাতিকে যা দিয়ে গেছেন তা অনন্য। তার মৃত্যুটা ছিল খুব করুণ। তিনি লক্ষ লক্ষ টাকা পেতেন না। তার সংসার চলত খুব কষ্টে।
প্রশ্ন : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই যুগে সার্বিকভাবে সাংবাদিকতা কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে? প্রিন্ট মিডিয়ার ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে?
মতিউর রহমান চৌধুরী : অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, একটি পত্রিকা বের করার যে ব্যয় সেটি অনেক বেশি। যে কারণে কাগজ টিকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে পড়েছে। কাগজ, কালি, প্রিন্টিং খরচ, প্রোডাকশন খরচ সবকিছুর ব্যয় অনেক বেশি। এসব বিষয়ে অবশ্যই সরকারি সহায়তার প্রয়োজন পড়বে। এটি সব দেশেই আছে। কাগজ, কালি আমদানির বিষয়ে ভর্তুকি দেওয়া প্রয়োজন। বরং আমরা দেখতে পাচ্ছি ট্যাক্স আরও বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে আমাদের উচ্চমূল্যে কালি কিনে ব্যবহার করতে হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, আমরা সাংবাদিকতার বিকাশের কথা বলছি, কিন্তু কণ্ঠরোধ করছি। এমন এক পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে যেখানে বলা হচ্ছে, আমার মতো করে লিখে বিকশিত হতে হবে। শুধুমাত্র একটি প্রতিবেদনের কারণে সরকার পরিবর্তন করা যায় না। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের দায়িত্বশীল সাংবাদিক হতে হবে। হঠকারিতার সুযোগ আছে বলেই হঠকারিতা করা যাবে না। সাংবাদিকতার নৈতিকতায় এটি বর্জনীয়। আইন করে কাউকে দায়িত্বশীল করা যায় না।
এটিও স্বীকার করতে হবে যে, রাজনীতি না থাকলে সাংবাদিকতা হয় না। কিন্তু সাংবাদিকদের প্রকাশ্য রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া যাবে না। রাজনীতি থাকবে পেটে আর কলম থাকবে নিরপেক্ষ। এ পার্থক্যটুকু আমরা করি না। আমরা দুটিকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলি। যে কারণে আমরা কিছু শিখতে পারছি না, দিতেও পারছি না। আমাদের সাংবাদিকদের কিন্তু দেওয়ার অনেক কিছু আছে…
তৃতীয়ত, রাজনীতি। এটি থাকবেই। কিন্তু সেই রাজনীতির প্রতিফলন যেন কাগজে না থাকে সেটি লক্ষ্য রাখতে হবে। সাংবাদিকের বিবেক, কলম, কম্পিউটার, কিবোর্ডকে নিরপেক্ষ রাখতে হবে। আমি অমুককে পছন্দ করি বলে তাকে নিয়ে ডাবল কলাম একটি স্টোরি ছাপতে পারি না। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে- বিবেক। আমরা জানি, ঘটনা কী, কে দোষী কিন্তু তারপরও আমরা বিবেকের দ্বারা তাড়িত হচ্ছি না, দৌড়াচ্ছি না। আমি যদি মনে করি যে, আমি এখানে থামব না তাহলেই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। কোনো বিষয়ে লিখতে সরকারের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করলে তো চলবে না। আমি নিজেও তো রিপোর্ট লিখে বহুবার চাকরি হারিয়েছি। ১৯৭৪ সালে চাকরি হারিয়েছি। জিয়াউর রহমানের সময় তিনবার আমার এক্রেডিটেশন বাতিল হয়েছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়ার আমলে আমি জেলে গেছি। বর্তমান সরকারের সময়েও আমি আট মাস দেশের বাইরে ছিলাম। দেশে ফিরতে পারিনি। এগুলো তো সাংবাদিকতারই অংশ। এরশাদের সময়ে আমার গাড়ি নিয়ে মির্জাপুরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আমি লিখেছিলাম ‘দুর্নীতিপরায়ণদের উল্লাসের নৃত্য’। যে কারণে ‘খবরের কাগজ’ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আমরা শুধু প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলাম। আগে আমাদের মধ্যে ওই জেদটা ছিল যে, এর শেষ দেখে ছাড়ব। একতরফাভাবে শুধু সরকারের দোষ দিতে আমি রাজি নই। খারাপকে খারাপ বলুন, খারাপকেও ভালো বলবেন এটি তো হতে পারে না।
যে কোনো সরকারই চায় গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে। এটাই তাদের চরিত্র। সাংবাদিকরা এসব পরিস্থিতিতে লড়াই করে সামনে এসেছেন। কিন্তু লড়াইটা এখন স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এজন্যই একের পর এক আইন তৈরি হচ্ছে। ধরে নিলাম সরকার স্বাধীনতা দিতে চায় না। কিন্তু স্বাধীনতা দিলেই তো হবে না, সেটা ভোগ করার মতো ক্ষমতাও তো থাকতে হবে।
প্রশ্ন : অনেক ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠার পর তা গণমাধ্যমে উঠে আসে। এ বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কি গণমাধ্যমকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে?
মতিউর রহমান চৌধুরী : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া সব খবরই যে ভুয়া তেমনটি কিন্তু নয়। অনেক সময় অনেক ভালো কনটেন্টও পাওয়া যায় এখান থেকে। এটিকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছি না। তবে এটিও স্বীকার করতে হবে, যখন মূলধারার গণমাধ্যম কোনো সত্যিকার খবর দিতে ব্যর্থ হচ্ছে তখন তা সোশ্যাল মিডিয়ার নজরে পড়ে যাচ্ছে। মূলধারার গণমাধ্যম যদি কোনো খবর গায়েব করতে চায় তখন কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দিকেই মানুষ বেশি ঝুঁকে পড়বে।