- ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলনে বিএনপি’র সংহতি
- ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইন সমীচীন নয় বলে জানান ওবায়দুল
লণ্ডন, ১৭ মার্চ: গত ১৫ মার্চ দ্য ডিপ্লোম্যাটে বাংলাদেশে ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন নিয়ে An ‘India Out’ Campaign Gathers Pace in Bangladeshi Social Media শিরোনামে এক নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। ‘ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব’ এর লেখা সেই নিবন্ধে বলা হয়েছে, জানুয়ারিতে আরেকটি একতরফা সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরে এসেছে আওয়ামী লীগ। এরপরই মালদ্বীপের মতো বাংলাদেশেও সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারাভিযান শুরু করেছেন। মূলত বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের অসন্তোষের প্রতিফলন এই ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারাভিযান। এটি শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক নির্বাচনের কারসাজির বিরুদ্ধে নয় বরং বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ সম্পর্কে ভারতের নীরবতাও এর পেছনে কাজ করেছে।
এক্টিভিস্টরা বলছেন, ভারত আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে মূলত তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষার জন্য। এই সমর্থনের মাধ্যমে নয়াদিল্লি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে ক্ষুন্ন করেছে। তাই সোশ্যাল মিডিয়া এক্টিভিস্টরা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের নিরলস হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে বাংলাদেশে এবং বিদেশে ভারতীয় পণ্য বয়কটের আহ্বান জানিয়েছেন। গত এক দশকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপি করেছে। এরফলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিশুদ্ধতা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। মনে করা হয়, ভারত শুধুমাত্র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কারসাজি উপেক্ষা করেই নয় বরং প্রার্থীদের পছন্দকে প্রভাবিত করার মাধ্যমেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট তৈরিতে সাহায্য করেছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বল হয়ে যাওয়া নিয়েও বাংলাদেশে উদ্বেগ রয়েছে।ভারত এসবের উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে বলে মনে হয়। ‘১৯৭১-২০২১ : বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের পঞ্চাশ বছর’ বইটিতে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন উল্লেখ করেছেন যে- “বাংলাদেশে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের জন্য ভারতের সম্মতি প্রয়োজন হয়।” ভারত সম্পর্কে এই উপলব্ধিগুলি এখন সোশ্যাল মিডিয়াতে “ইন্ডিয়া আউট” প্রচারনায় ইন্ধন যোগাচ্ছে। তবে প্রচারণার দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার সম্পর্কটি বেশ জটিল। এ সম্পর্ক ঐতিহাসিক বন্ধন, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ এবং পারস্পরিক আর্থ-সামাজিক নির্ভরতার ওপর দাঁড়িয়ে। বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ২০২২ অর্থবছরে ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ছিল ১৬.১৬ বিলিয়ন ডলার। খাদ্য, জ্বালানি, সার এবং শিল্পের কাঁচামালের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যগুলির জন্য ভারতের উপর এই অত্যধিক নির্ভরতা এবং এর দেশীয় বিকল্প কম থাকায়, বাংলাদেশ চীন থেকে এসব পণ্য আমদানি শুরু করতে বাধ্য হতে পারে। এতে চীনের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা বাড়বে। ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন বাংলাদেশের কর্পোরেট সেক্টরে, বিশেষ করে সফ্টওয়্যার এবং পরিষেবা-ভিত্তিক ব্যবসার পাশাপাশি বাংলাদেশে ভারতীয় দক্ষ কর্মী এবং বিশেষজ্ঞদের নিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে পারে ।
‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণার সমালোচকরা যুক্তি দেখান যে, এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনী অনিয়ম এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার মতো মৌলিক বিষয়গুলি থেকে মনোযোগ সরানো হচ্ছে। অন্যদিকে এর সমর্থকরা দাবি করেন যে, এটি ভিন্নমত প্রকাশ করার এবং কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করার একটি উপায় হিসাবে কাজ করছে। যদিও নির্বাচনী জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত আওয়ামী লীগ, তবে প্রায়শই ভারতকে এই কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয়। এটা ঐতিহাসিকভাবেও সত্য। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭৫ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে এবং একদলীয় ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা বাকশাল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে, তখন এর জন্য ভারতকেই দোষারোপ করা হয়েছিল। অনেকেই মনে করেন, ভারতের সমর্থন না থাকলে আওয়ামী লীগ এত বড় পদক্ষেপ নিতে পারতো না।
স্বার্থান্বেষী মহল বয়কট প্রচারাভিযানকে ব্যাহত করার জন্য গোপন কৌশল অবলম্বন করতে পারে বলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তারা সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন করতে পারে, এমনকি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে এবং বিরোধীদের দোষারোপ করতে বাংলাদেশে কর্মরত ভারতীয় প্রবাসীদের ভয় দেখাতে পারে। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন যে, ইন্ডিয়া আউট প্রচারাভিযান ভারত ও বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলির মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শত্রুতা বপন করার একটি কৌশল হতে পারে, যা সম্ভাব্যভাবে ক্ষমতাসীন দলকে উপকৃত করবে।
আশ্চর্যজনকভাবে, বাংলাদেশ সরকারকে এই প্রচারণা নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন বলে মনে হচ্ছে না। কেউ কেউ অনুমান করেন যে, সম্ভাব্য সুবিধার কথা ভেবেই হয়ত এই উদাসীনতা সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, ভারত বয়কটের মধ্য দিয়ে আমদানি হ্রাস ও বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণ হচ্ছে, যা চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে সুবিধাজনক হতে পারে। নয়াদিল্লিকে অবশ্যই এই ভারত-বিরোধী ধারণাগুলিকে মোকাবেলা করতে হবে এবং বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান ভারত-বিরোধী স্রোতের অন্তর্নিহিত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইনের জন্য সরাসরি আহ্বান না করে, বাংলাদেশি অ্যাক্টিভিস্টদের উচিত সুশীল সমাজের সংগঠনগুলির মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করা। বিভিন্ন একাডেমিক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছানো এবং তাদের সংলাপে যুক্ত করা। যদিও পণ্য বয়কট করার অধিকার সর্বজনীন, তবে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল ভারতকে বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত যেকোনো সরকারের সাথে কাজ করার মানসিকতা রাখতে হবে। অন্যান্য দল এবং গোষ্ঠীগুলিকে বাদ দিয়ে একা আওয়ামী লীগের সঙ্গে একচেটিয়া সম্পর্ক বজায় রাখার পরিণতি সম্পর্কে ভারতের সতর্ক হবার সময় এসেছে। বাংলাদেশিদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্খাকে সম্মান করতে এবং জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সমস্ত দলের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য ভারতকে বোঝানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্টদের ভারতীয় সুশীল সমাজ, একাডেমিয়া এবং কূটনৈতিক চ্যানেলগুলি ব্যবহার করা উচিত।
ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলনে বিএনপি’র সংহতি
বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে ঢেউ দৃশ্যমান তাতে মনে হয় দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছে। সুতরাং জনগণের দল হিসেবে বিএনপি সহ ৬৩টি গণতন্ত্রকামী দল এবং দেশপ্রেমিক জনগণ ভারতীয় পণ্য বর্জনের এই আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করছে। রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের জনগণ ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অরাজক, লুটেরা, খুনি ও গণধিকৃত বাকশালী শাসনের পক্ষে সহযোগিতা করছে। গণনিপীড়ক-হন্তারক-মাফিয়া সরকারকে প্রকাশ্যে মদত ও সমর্থন দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ এখন একটি ভারতীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে। যা স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বার্থ ও মর্যাদার পরিপন্থি।
রিজভী আরও বলেন, গত কয়েকদিন ধরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জনগণের ভোটাধিকার হরণ, গণতন্ত্র হত্যা এবং বিনা ভোটে অবৈধ ক্ষমতার অমরত্ব লাভের অপচেষ্টায় প্রতিবেশী ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও মদতের স্বীকারোক্তি প্রদান করে জোর গলায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। কথায় কথায় প্রায় সব মন্ত্রী ভারত বন্দনায় মত্ত হচ্ছেন। তাদের কথাবার্তা ও আচার-আচরণে মনে হচ্ছে-বাংলাদেশ এখন ভারতের স্যাটেলাইট রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনে ভারতের ভূমিকার বিষয়ে সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশের জনগণের সমর্থন বা শক্তিতে নয়, ভারতের শক্তি ও সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ অবৈধভাবে ক্ষমতার সিংহাসনে টিকে আছে। আর এই টিকে থাকার জন্য যত দমন-পীড়ন-গুম-খুন-হত্যা-মামলা-হামলা-অবিচার-অনাচার সব কিছু করছে সরাসরি ভারতের মদতে। ওবায়দুল কাদের ও ড. হাছান মাহমুদের অকপট স্বীকারোক্তি প্রমাণ করে জাতিসংঘ সনদের ২ (৪) ধারা সরাসরি লঙ্ঘন করে ভারত আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ভোটাধিকার সব কিছুর উপর সরাসরি নগ্ন হস্তক্ষেপ করে চলেছে। ২ (৪) ধারায় বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সকল সদস্য-রাষ্ট্র আঞ্চলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোনো রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন থেকে এবং জাতিসংঘের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন কোনো উপায় গ্রহণ করা থেকে নিবৃত্ত থাকবে’। আওয়ামী লীগ নেতাদের কথায় স্পষ্ট যে, ভারত এ নীতি লঙ্ঘন করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে। সংবাদ সম্মেলনের পর বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ভারতীয় চাদর জনসম্মুখে ছুড়ে ফেলে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ঘোষণা দেন রুহুল কবির রিজভী।
ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইন সমীচীন নয় বলে জানান ওবায়দুল
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভারত পাশে ছিল বলেই বাংলাদেশের নির্বাচনে বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। শনিবার (১৬ মার্চ) রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের যে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের দেয়াল ছিল তা ভেঙে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো বলে সিট মহল বিনিময় ৬৮ বছরের যে সমস্যা তার শান্তিপূর্ণ সমাধান করেছেন। তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এর সমাধানও অবশ্যই হবে, ধৈর্য ধারণ করতে হবে। গায়ে পড়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ততা করে সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। এছাড়া সামাজিক মাধ্যমে যে ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইন এটি সমীচীন নয় বলেও জানান ওবায়দুল কাদের। তিনি প্রশ্ন রাখেন ভারত বিরোধী মনোভাব কেন জাগ্রত করার চেষ্টা করা হচ্ছে? যারা নির্বাচনে আসেনি এটি তাদের অপপ্রচারে একটা ঢাল। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে তখন ভারত বিরোধিতায় লিপ্ত হয় একটি মহল। এখনো তারা সেটি করছে।