- ঢাবির সেমিনারে ‘ভারতের জাতীয় সংগীত’
- রমজানের আলোচনায় ছাত্রলীগের হামলা
- রমজান বিষয়ক অনুষ্ঠান আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা
লণ্ডন, ২১ মার্চ: গত ১৬ বছরে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফলে প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অচলাবস্থা, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন, প্রশ্ন ফাস ও রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক কিউএস র্যাঙ্কিংয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পিছিয়ে থাকা- ইত্যাকার ইস্যুগুলোই সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে ভারতের জাতীয় সংগীত, রমজানের আলোচনায় ছাত্রলীগের হামলা ও রমজান বিষয়ক অনুষ্ঠান আয়োজনে নিষেধাজ্ঞায় দেশের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা আবারও আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে এসেছে।
এ বাস্তবতায় পুনরায় প্রশ্ন উঠছে, প্রকৃত অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? অথবা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে? জনপরিসরে এ ধরনের প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছুদিন আগে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাতেমাতুজ জিনিয়া তার ফেইসবুকে প্রশ্ন রেখেছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে উপাচার্য তার বেশ হেনস্তা করেছিল। আচার্য মানে প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী; উপাচার্য তার কাছাকাছি। উপাচার্য জ্ঞানী হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নির্ভর করে উপাচার্যের গুণ-মান-দক্ষতার ওপর। দলীয় সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় নিয়োগকৃত প্রশ্নবিদ্ধ প্রজ্ঞা-সংজ্ঞার মানুষের দ্বারাই অবিমৃশ্যকারিতা সম্ভব।
যাইহোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎপত্তি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘… বিশেষ দেশ, বিশেষ জাতি যে বিদ্যা সম্বন্ধে বিশেষ প্রীতি, গৌরব ও দায়িত্ব অনুভব করেছে তাকেই রক্ষা ও প্রচারের জন্যে স্বভাবতই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সৃষ্টি’। যা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ প্রতিষ্ঠার পেছনে সক্রিয় কি না তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞান সৃজন ও সঞ্চালনের প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশেষ সাধনার ক্ষেত্র, বিশ্ববিদ্যালয় হবে ভিন্নমতের চারণক্ষেত্র। অথচ প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছেটা কী?
ঢাবির সেমিনারে ‘ভারতের জাতীয় সংগীত’
ভারতের জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠান শুরু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় চলছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের ৫২ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারের আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বীর মুক্তিযোদ্ধা কে এম বজলুর রহমান ফাউন্ডেশনের যৌথভাবে। সেমিনারে ভারতীয় সংগীত দিয়ে শুরু করার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। তারা নানা ভাবে এ নিয়ে মন্তব্য করেন।
রমজানের আলোচনায় ছাত্রলীগের হামলা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রমজানের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও মাসলা-মাসায়েল’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় হামলার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। এতে ৬ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আলোচনা সভাটির আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের কিছু শিক্ষার্থী। দুপুর পৌনে ২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের মসজিদে এ হামলার ঘটনা ঘটে। শাহবাগ থানা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মো. তাওহীদুল ইসলাম সুজনের নেতৃত্বে এ হামলা হয় বলে জানা গেছে। সূত্রমতে, আইন বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী জোহরের নামাজ পড়তে বঙ্গবন্ধু টাউয়ারে আসেন। এসময় তারা নামাজ শেষে রমজানের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও মাসলা-মাসায়েল সম্পর্কে আলোচনা করতে চাইলে বাধা দেন বঙ্গবন্ধু টাউয়ার কর্মচারী সমিতির সভাপতি সিরাজুল হক। এখানে আলোচনা করা ভিসি ও প্রক্টর থেকে নিষেধ করা আছে। এবং সেন্ট্রাল মসজিদ ব্যতীত অন্য কোথাও রমজানের আলোচনা করা যাবে না বলে জানান তিনি। এ সময় ছাত্রলীগ নেতা তাওহীদুল ইসলাম সুজন শিক্ষার্থীদের মসজিদ থেকে বের হতে বলেন। শিক্ষার্থীরা মসজিদ থেকে বের হয়ে সেন্ট্রাল মসজিদের দিকে যেতে চাইলে গেটের মুখেই তাওহীদুল ইসলাম সুজন ও তার অনুসারীরা তাদের ওপর হামলা করে। তাদেরকে রাস্তায় ফেলে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি দিতে থাকেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী শামীম শহীদী বলেন, আমার তাবলীগের বন্ধু ও বড় ভাইয়েরা রোজার আমল ও ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করতে বঙ্গবন্ধু টাউয়ারের মসজিদে আসি। আমরা আগেই এটা প্রচার করেছি যে, আমরা রোজার ফজিলত, মাসলা-মাসায়েল নিয়ে আলোচনা করবো। কিন্তু হঠাৎ অপরিচিত কয়েকজন মসজিদে এসে আমাদের বের হতে বলে। তাছাড়া টাউয়ারের কর্মচারীরাও আমাদের চলে যেতে বললে আমরা বের হই। এ সময় আমরা গেটের কাছাকাছি আসতেই ৩০/৪০ জন আমাদের ওপর হামলা করে। পরে আমরা জানতে পারি তারা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ছিল। তাবলীগের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করবে আমরা ভাবতেও পারিনি। বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের গেট দারোয়ান বলেন, শিক্ষার্থীরা বাইরে বের হতে না হতেই আগে থেকে পাশে অপেক্ষা করা কিছু ছেলে তাদের ওপর হামলা করে। এ সময় কয়েকজনকে রাস্তায় ফেলে এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ (পরিদর্শক) মো. বাচ্চু মিয়া জানান, আহত তিনজনের অবস্থা গুরুতর। শাহিনুরকে জরুরি বিভাগের নিউরোসার্জারি ও সাকিবকে নাক, কান, গলা বিভাগে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
রমজান বিষয়ক অনুষ্ঠান আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) রমজানের আলোচনা সম্পর্কিত অনুষ্ঠান আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ সম্পর্কিত কোনো অনুষ্ঠানের অনুমতি না দিতে হলের প্রভোস্ট, অনুষদের ডিন ও ইনস্টিটিউটের পরিচালকদের চিঠি দিয়েছে প্রক্টর অফিস। গত ২০ মার্চ বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মাকসুদুর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, কিছু রাজনৈতিক সংগঠন ও রাজনৈতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়েছে। একইসঙ্গে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানোর জন্য এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনার অনুমতি না দেয়ার অনুরোধ করছে। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী ‘প্রোডাক্ট রমাদ্বান’ শিরোনামে রমজানবিষয়ক আলোচনার আয়োজন করে। সেখানে হামলার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। হামলায় অন্তত ৬ জন গুরুতর আহত হয়। চিঠির বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রক্টর ড. মাকসুদুর রহমান বলেন, আমরা একটি তদন্ত কমিটি করেছি। একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটে গেছে। তদন্তকালীন অন্য কোনো অঘটন ঘটলে আমাদের কাজ কঠিন হয়ে পড়বে। এ কারণে আমরা চিঠি দিয়েছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করছেন হাজার হাজার মানুষ। নেটিজেনরা প্রথম রোজার দিন সম্মিলিতভাবে ভারতীয় সংগীত দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার শুরু করার প্রতিবাদ করে বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ইফতার করা যাবে না, তবে ভিনদেশের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া যাবে। সার্বভৌমত্বের আর কোনকিছু বাকি রইলোনা এই দেশে। সেটা শেষ হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতেই। এটা ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে গাওয়া হচ্ছে ‘ভারতের জাতীয় সঙ্গীত’। এই হচ্ছে আমার, আপনার, আমাদের সকলের স্বাধীন বাংলাদেশ।