।। নাদিম মাহমুদ ।।
আবরার ফাহাদকে নির্যাতন ও হত্যার জেরে প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ রয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। এই সময়ের মধ্যে যখনই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাসে সচল হতে চেয়েছে, তখনই সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন, বিক্ষোভ-সমাবেশ করছেন। শিক্ষার্থীদের এসব প্রতিবাদে অনেকটাই স্পষ্ট, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ছাত্ররাজনীতিতে আগ্রহী নন।
কিন্তু কেন তাঁরা ছাত্রসংগঠনগুলোকে অপছন্দ করছেন? বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রসংগঠনগুলোর যেখানে সক্রিয় ভূমিকা ছিল, সেই জায়গা থেকে একটি বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি বিমুখিতা দেখিয়ে আমাদের জন্য কী বার্তা দিচ্ছে? বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে, শিক্ষার্থীদের জন্য কেবল পড়াশোনা ও গবেষণার সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টিতে বুয়েট প্রশাসন যে ভূমিকা রাখছে, সেটি কি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অনুকরণীয় হয়ে উঠছে?
এসব নিয়ে আলোচনা করার আগে পাঠক চলুন আমরা ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একটু আলোচনা করি।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, আশির দশকে স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে এই দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কারণ, এই তরুণদের শক্তিকেই সারা বিশ্বের শাসকগোষ্ঠীরা ভয় পায়, সমীহ করে কিংবা ক্ষমতার মসনদের নড়াচড়া করে। ফলে পঞ্চাশ বছরের অধিক সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্ররাজনীতির চর্চা চলে আসছে।
মূল রাজনৈতিক দলগুলোর ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে ছাত্রসংগঠন তৈরি করেছে। এসব রাজনৈতিক দলকে বিভিন্ন সময়ে ‘ক্ষমতা’ পাকাপোক্তকরণে ছাত্রসংগঠনগুলো প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে একটা বড় ভূমিকাও রাখছে। অন্যদিকে দেশের সংকটকালে এসব ছাত্রসংগঠন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে।
বড় দৃষ্টিতে ছাত্রসংগঠনগুলোর অতীতের এসব ভূমিকার কারণে ‘ছাত্ররাজনীতি’ সাধারণ মানুষ গ্রহণ করলেও কয়েক দশক ধরে ছাত্ররাজনীতি ‘শিক্ষা’ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক তৈরি করে আসছে। যখন কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গিয়েছে, তখনই বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজগুলোয় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলো আধিপত্য, দাপট, চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নিপীড়ন, খুনোখুনিতে মেতে উঠেছে।
মানুষ হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ করতে এসে লাশ হয়ে ফিরেছেন কয়েক ডজন শিক্ষার্থী। এসব লাশের বোঝা স্বভাবত পরিবারগুলোর কাছে ভারী হয়ে গিয়েছে। স্কুল-কলেজের মেধাবী ছাত্রটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে ছাত্ররাজনীতির জাঁতাকলে নিজের ভবিষ্যৎকে বিকিয়ে দিয়েছেন, হামলা-মামলায় জড়িয়ে পড়াশোনাকে বিসর্জন দিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এসব নিয়মিত ঘটনা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তরুণদের মধ্যে ‘ছাত্ররাজনীতি’ বিষময় করে তুলেছে। পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়বে, অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল, তমুককে মারধর করে হল থেকে বের করে দেওয়া, চাঁদার টাকা দিতে না পারলে মারধর, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, অন্যের জিনিস কেড়ে নেওয়াসহ নানান অপকর্মের কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতিকে ‘ভয় পান’ কিংবা সমীহ করে চলেন।
বলতে দ্বিধা নেই, বিভিন্ন সময়ে হামলা-সংঘর্ষের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থেকেছে, সেশনজট তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। যদিও এসব অপকর্মের সময়ে অধিকাংশ সময় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলো জড়িয়ে থাকলেও বিপক্ষের শিবিরের ছাত্ররাজনীতিতেও আধিপত্য, হাঙ্গামার ঘটনা শিক্ষার্থীদের সামগ্রিকভাবে ছাত্ররাজনীতির প্রতি একধরনের ‘নিম্নমানের’ ধারণা তৈরি করছে।
প্রশ্ন হলো, কেন ছাত্ররাজনীতি করা প্রয়োজন? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? বিষয়টি নিয়ে যদি রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রশ্ন করা হয়, তাহলে তাঁদের প্রথম যুক্তি হবে এ রকম, ছাত্ররাজনীতি না থাকলে দেশের ভবিষ্যৎ নেতা তৈরি হবে না। দেশপ্রেম তৈরি করতে কিংবা লিডারশিপ গড়তে হলে ছাত্রদের রাজনীতি করতে হবে।
দ্বিতীয় যুক্তি হবে, ছাত্ররাজনীতি না থাকলে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চালান, তাঁদের মধ্যে দুর্নীতিপ্রবণ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকবে। তাঁরা যেন কোনো অপরাধ-অনিয়ম করতে না পারেন, সে জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি প্রয়োজন।’
প্রথম যুক্তির উত্তর খুঁজলে দেখা যাবে, দেশে ছাত্ররাজনীতি করে আসা মানুষেরা আদৌও দেশ চালানোর ভূমিকায় থাকছেন কি না। ছাত্ররাজনীতি করে নিজেদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণ তৈরি কতটুকু হচ্ছে, কিংবা তাঁদের কতটুকু মূল্যায়ন করা হচ্ছে, সেই উত্তর পাওয়া যাবে চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরে।
ওই খবরে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) দাবি করছে, এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত ২৯৯ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ২০০ জনের পেশা ব্যবসা। শতকরা হিসাবে সংসদ সদস্যদের ৬৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ ব্যবসায়ী। একাদশ জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী ছিলেন ১৮৫ জন বা মোট সংসদ সদস্যের ৬১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ, দুই-তৃতীয়াংশ ব্যবসায়ীদের দখলে থাকা জাতীয় সংসদ আমাদের শাসক, আইনপ্রণেতা। ২৯৮টি আসনের মধ্যে রাজনীতিবিদ ছিলেন মাত্র ২৬ জন। খাসা রাজনীতি করে আসা হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ সংসদ সদস্য রাজনীতির বাইরে থেকে এসে দেশ পরিচালনার হাল ধরছেন। শুধু জাতীয় নির্বাচন নয়, স্থানীয় নির্বাচনেও এক ধরনের চিত্র দেখা যায়।
এখন প্রশ্ন হলো, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্ররাজনীতি করে আসা, নেতৃত্ব দিয়ে আসা ব্যক্তিদের এই যদি হয় মূল্যায়নের চিত্র, তাহলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্ররাজনীতির প্রতি উৎসাহ কতটা তৈরি হবে? জাতীয় রাজনীতিতে যদি তাঁদের নিয়ে না আসা হয়, তাহলে ছাত্ররাজনীতি নামে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আধিপত্য, অস্ত্রের ঝনঝনানি, চাঁদাবাজি, মামলা-হামলায় নির্যাতিতদের রাজনীতি করার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?
দ্বিতীয় যুক্তির চাক্ষুষ প্রমাণ আমাদের গণমাধ্যমগুলো। নিত্যদিনই খবরের শিরোনাম হয়েছে—চাকরি দিতে, টেন্ডার নিতে, নির্মাণাধীন ভবনের কাজ আটকিয়ে, আবাসিক হলের সিট দিতে, দোকানপাটগুলো থেকে চাঁদাবাজিসহ নানান ধরনের দুর্নীতিতে জড়িয়ে গেছে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলো। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি রোখার জন্য যাঁরা ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন বলে দাবি করেন, সেই দাবিও অসাড় হয়ে পড়ছে।
সবচেয়ে নির্মোহ সত্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্ররাজনীতিতে যেসব সাধারণ শিক্ষার্থী জড়িয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁরা মূলত ভবিষ্যতের ফায়দা তোলার জন্য মিছিল-সমাবেশে যান। নেতাদের পেছনে পেছনে ঘোরেন। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে কর্মজীবনের ঢুকতে যে রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রয়োজন, তার জন্য ‘রাজনৈতিক’ পরিচয় থাকা বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়ছে। ফলে একদল শিক্ষার্থী বাধ্য হয়েই ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
‘‘কেবল ছাত্ররাজনীতি নয়, লাল-নীল-সবুজ-সাদার চাদরে ঢাকা শিক্ষকরাজনীতির পক্ষেও মত দিতে পারছি না। রাজনৈতিক এসব প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে ক্যাম্পাসগুলোয় পদ-পদবি তৈরির পথ সুগম যেমন হয়, তেমনি শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্টেও তাঁরা ভূমিকা রাখছে বৈকি। আমি অকপটে বলে দিতে পারি, এই দেশের লাখো শিক্ষার্থী ‘বুয়েটের রাজনৈতিক মডেল’ তাঁদের প্রতিষ্ঠানেও দেখতে চায়। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শিক্ষার্থীদের চোখ-মুখে ‘রাজনীতি’ থেকে দূরে থাকার অভিপ্রায় জোরালো হচ্ছে।”
অন্যদিকে শিক্ষকেরাও ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের ওপর দারুণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। সমীহ করে চলেন, তাঁদের নানার ধরনের আবদারও মেটাচ্ছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সোচ্চার থাকলেও প্রশাসনের পক্ষেই ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলো সাফাই গাইছে। তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মসনদে নানাবিধ লোভে ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার ও দাবি আদায়ের লক্ষ্য পূরণে যেমন ব্যর্থ হচ্ছে, তেমনই তাদের অন্যায়-অনিয়ম-দুর্নীতির মোচড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতির প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, যদি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ছাত্রসংগঠনের নেতিবাচক ভূমিকা থাকে, তাহলে অন্যদের বেলায় কী? তারা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছে?
একটা সময় রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রগকাটা সংস্কৃতি চালু ছিল। এখনো মাঝেমধ্যে খবর হয়। ক্ষমতার বাইরে থাকা ছাত্রসংগঠনগুলো ক্যাম্পাসে আধিপত্য পেতে সংঘর্ষে জড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অস্থিতিশীল করে তোলার ঘটনা নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে এসব পক্ষে-বিপক্ষের রাজনীতির জাঁতাকলে অনেক শিক্ষার্থীকে যেমন প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে, তেমনি পঙ্গুত্ব, অন্ধত্ব নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন অনেকেই।
আবার ক্যাম্পাসের সেই অস্ত্রবাজ শিক্ষার্থী একটা সময় পদ না পেয়ে, চাকরি না পেয়ে রাজনীতির বড় খেসারতটা দিয়ে যাচ্ছেন। ফলে ছাত্ররাজনীতির যে ভয়াল চেহারা আমাদের সামনে ধরা পড়ছে, হোক সেটা ক্ষমতাসীন কিংবা বিরোধী শিবিরের, দিন শেষে তা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
ছাত্ররাজনীতিতে পচন শুরু হওয়ার পরও জাতীয় রাজনীতিবিদেরা যখন সতর্ক হননি, সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি সীমাহীন অত্যাচার হওয়ার পরও যখন তাঁদের ঘুম ভাঙেনি, তখন ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাওয়াকে অস্বাভাবিক বলা চলে না। সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া আদায়ে পিছিয়ে থাকার পরিপ্রেক্ষিতে জনমনে যেমন ক্ষমতাসীন ছাত্ররাজনীতির প্রতি একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে, তেমনই সাধারণ শিক্ষার্থীরাও রাজনীতি করার সাহস পাচ্ছেন না। যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁরা মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক সুবিধা আদায়ে বেশি সচেষ্ট থাকছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, কেবল ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করলেই কি শিক্ষার পরিবেশ ফিরবে? বুয়েট শিক্ষার্থীদের পক্ষে ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর যে আদেশটি জারি করে সব রাজনৈতিক সংগঠন এবং এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জানানো হয়েছিল, সেটি কি শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করতে পেরেছে? রাজনীতি না করলে যেখানে উপাচার্যের পদই পাওয়া যায় না, সেই পদটি কি রাজনীতিবিমুক্ত করতে পেরেছে? কিংবা শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ মহড়া সেটিকে রুখতে পেরেছে?
কেবল শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চর্চা সংকুচিত করে ‘রাজনীতিমুক্ত’ ক্যাম্পাস গড়ার সুফল ঘরে কতটা উঠছে, তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন থাকবে, তেমনি শিক্ষকরাজনীতির করাল গ্রাস থেকে ‘শিক্ষার’ সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করাও দুরূহ হয়ে পড়বে। ওত পেতে থাকা সাম্প্রদায়িক শক্তির অবাধ চর্চাক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে কি না, তা-ও দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে পৃথিবীর অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের মতো এই রকম ভয়াবহ ছাত্রসংগঠনের দাপাদাপি নেই। পড়তে গিয়ে লাশ হতে হয় না। পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় না। শিক্ষক বা চাকরি হতে গেলে ছাত্ররাজনীতির পরিচয় থাকতে হয় না। তাই বলে কি সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃত্ব তৈরির কারখানা বন্ধ রয়েছে? সেসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নেতৃত্ব তৈরির চর্চা হচ্ছে না?
কেবল ছাত্ররাজনীতি করলেই নেতৃত্ব বা লিডারশিপ গুণ তৈরি হয় না, বরং নেতৃত্ব তৈরির নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা সেসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় রয়েছে। আজকের বিশ্বনেতাদের সিংহভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্লোগান, মিছিল দিয়ে নেতৃত্বে আসেননি, বরং নিজেদের যোগ্যতা, কাজ ও মানসিক শক্তির সমন্বয়ে জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়তা তৈরি করেছেন, দৃঢ় অঙ্গীকার বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করছেন। রাজনীতির বাইরে অফিস, আদালতে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ে নানা রকম সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই তৈরি হয়েছে।
অন্য দেশগুলো ছাত্ররাজনীতির বাইরে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ কিংবা শিক্ষার্থীদের যাবতীয় অধিকার আদায়ে গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ছাতাতলে আসীন হলেও আমাদের দেশে সেসব কাজে দিচ্ছে না। নিরপেক্ষ ছাত্রসংসদ থেকে একসময় দাপুটে নেতা তৈরি হলেও সেই জায়গা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে, কিংবা সচল থাকলেও রাজনৈতিক ছায়া পড়ছে। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক চর্চার পথ ছোট হয়ে গিয়েছে।
কেবল ছাত্ররাজনীতি নয়, লাল-নীল-সবুজ-সাদার চাদরে ঢাকা শিক্ষকরাজনীতির পক্ষেও মত দিতে পারছি না। রাজনৈতিক এসব প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে ক্যাম্পাসগুলোয় পদ-পদবি তৈরির পথ সুগম যেমন হয়, তেমনি শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্টেও তাঁরা ভূমিকা রাখছে বৈকি। আমি অকপটে বলে দিতে পারি, এই দেশের লাখো শিক্ষার্থী ‘বুয়েটের রাজনৈতিক মডেল’ তাঁদের প্রতিষ্ঠানেও দেখতে চায়। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শিক্ষার্থীদের চোখ-মুখে ‘রাজনীতি’ থেকে দূরে থাকার অভিপ্রায় জোরালো হচ্ছে।
আপনি যদি ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে কথা বলেন, তাহলে আপনাকে শিক্ষকরাজনীতির বিপক্ষেও কথা বলতে হবে। আপনি যদি গণতান্ত্রিক চর্চার এই ক্ষেত্র বন্ধ রাখতে চান, তাহলে অন্যান্য গণতান্ত্রিক চর্চার পথও খুলে দিতে হবে। বুয়েট যেভাবে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করেছে, সেই মডেল অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সংক্রমিত হবে কি না, তা শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করছে বলে সরকারপ্রধান অতীতে জানিয়েছেন। তবে এ কথা ঠিক, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য পাঠিয়ে অন্তত বুয়েটের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা কিছুটা হলেও শঙ্কামুক্ত থাকতে পারছেন।
হ্যাঁ, আমি ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে মত দিচ্ছি না, তবে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্ররাজনীতির যে চর্চা চলছে, তাকে সমর্থন জানানো বিবেকবানদের পক্ষে সম্ভব নয়। আধিপত্য, সংঘর্ষ, রক্তপাতের রাজনীতি ছাত্র অবস্থায় দেখা কাম্য নয়। পড়তে এসে চাঁদাবাজ, অস্ত্রবাজ কিংবা যৌন নিপীড়কদের কাতারে চলে যাওয়ার রাজনীতিকে সমর্থন দেওয়ার শক্তি আমাদের নেই। এসব নোংরামি থেকে বের হতে হবে।
ছাত্রসংগঠনগুলোর ওপর ভর করে যাঁরা ক্ষমতায় যেতে চান, তাঁদের সেই চিন্তাভাবনা বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীদের পক্ষে সব অনিয়ম-অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার শক্তি যদি ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে না থাকে, তাহলে সেটিকে কখনোই শিক্ষার্থীবান্ধব সংগঠন বলা চলে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে আমাদের রাজনীতিবিদের উদারতাই যথেষ্ট। এখন সিদ্ধান্ত তাঁদের হাতে!
নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: nadim.ru@gmail.com