লণ্ডন, ২৩ জুলাই: বিশ্বের সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্তগুলোর মধ্যে এখন বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত একটি। দেশ দুইটির উচ্চপর্যায় থেকে সীমান্ত হত্যা বন্ধে নানা প্রতিশ্রুতি কোন কাজে আসছে না। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডে শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরাও। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রামের বাসিন্দারা প্রায়ই ঝুঁকি নিয়ে ভারতে যান। প্রতিবেশী দেশে যেতে গিয়ে প্রাণও যায় তাদের৷ গত ৫ বছরে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৮ জন বাংলাদেশির। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও গ্রামবাসীদের একাংশ মনে করেন দারিদ্র্যের কারণেই মৃত্যু-ঝুঁকি আছে জেনেও অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করেন অনেকে৷
সর্বশেষ গত রবিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে কোম্পানীগঞ্জের কালাইরাগ ভারত সীমান্ত এলাকার ১২৫৩ নম্বর পিলারের পাশে ‘ভারতীয় খাসিয়াদের’ গুলিতে কালীবাড়ি গ্রামের আলী হোসেন (৩০) ও কাওসার আহমদ (৩২) নিহত হন। পরর দিন, অর্থাৎ সোমবার রাত আটটার পর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কালাইরাগ সীমান্ত এলাকা দিয়ে তাদের লাশ দেশে আনা হয়।
নিহত যুবকদের মধ্যে আলী হোসেন বিবাহ সূত্রে কালীবাড়ি গ্রামে থাকতেন। তার শ্বশুর আমীর খাঁ। আর কাওসার আহমদ মামা বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন। তার মামা ওসমান গনি। কাওসার ঢাকায় থাকতেন। ওসমান গনি বলেন, “কাওসার বেড়াতে এসেছিল। আলী হোসেনের সঙ্গে গরু আনতে সীমান্ত পার হয়ে ওপারে গিয়ে মারা যায়।” আর আমীর খাঁ বলেন, “সে সীমান্তের ওপারে গিয়ে কিছু কাঠ সংগ্রহ করতো। পাশাপাশি গরুর জন্য ঘাসও কেটে আনতো। বিনা কারণে খাসিয়ারা তাদের গুলি করেছে।”
নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও কেন তারা সীমান্তের ওপারে যান জানতে চাইলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার উত্তর রনিখাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. ফয়জুর রহমান বলেন, “আমরা তো বারবার সতর্ক করছি। তারপরও তারা যাচ্ছে। ওখানে গিয়ে তারা জ্বালানির কাঠ সংগ্রহ করে। পাশাপাশি কিছু সুপারি, কাঁঠালও নিয়ে আসে। এসব কারণেই খাসিয়ারা তাদের গুলি করে।” বিজিবি সেখানে দায়িত্বে থাকে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সীমান্তের পুরো এলাকায় তো বিজিবি থাকা সম্ভব নয়। আর ওরা তো রাস্তা দিয়ে যায় না। জঙ্গলের যেখানে সুযোগ পায়, সেখান দিয়ে ঢুকে যায়। বরং আমাদের বিজিবি যতটা তৎপর, ভারতের বিএসএফ অতটা তৎপর না। তারা তৎপর থাকলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। আমরা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করছি, তারপরও কিছু মানুষ যাচ্ছে। বিজিবিও প্রায়ই উঠান বৈঠকে গ্রামবাসীকে এসব বোঝায়।”
সীমান্তে কি কাঁটাতারের বেড়া আছে? রনিখাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ফকরু মিয়া বলেন, “সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া আছে।” তাহলে এই মানুষগুলো কিভাবে ওপারে যাচ্ছে? তিনি বলেন, “কালিবাড়ি গ্রামের পাশে একটা ব্রিজ আছে। ওই ব্রিজের নিচে খালে কোনো পানি নেই। হেঁটেই যাওয়া যায়। ওরা ব্রিজের নিচ দিয়ে গরু নিয়ে হেঁটে চলে যায়।” ওপারে গরু চরাতে বা কাঠ কাটতে যায়৷ ভারত সীমান্তে তো পাহাড়। ওখানে প্রচুর গাছপালা। আবার অনেক ঘাসও আছে। ফলে কম কষ্টে এগুলো সংগ্রহের জন্য তারা যাচ্ছে। আমি মেম্বার হিসেবে গ্রামের প্রতিটি বাড়ি ঘুরে সবাইকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছি, তবুও তারা যাচ্ছে।”
এর আগেও খাসিয়াদের গুলিতে এ অঞ্চলের মানুষ মারা গেছেন। গত বছরের ২০ জুলাই জৈন্তাপুর উপজেলার লালাখাল সীমান্তের তেলাঞ্জি নামক স্থানে ভারতীয় খাসিয়াদের গুলিতে একজন বাংলাদেশি নিহত ও দুইজন আহত হন। সারী নদীর ১৩০১ নম্বর মেইন পিলারের পাশে এ ঘটনা ঘটে। খাসিয়াদের গুলির পর কালিঞ্জিবাড়ী গ্রামের মৃত ইসমাইল মিয়ার ছেলে রুবেল হোসেন (২২) পানিতে পড়ে যান। উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তির পর তিনি মারা যান। ওই সময় গুলিতে আহত হন উত্তর কামরাঙ্গী গ্রামের মোহাম্মদ আলীর দুই ছেলে আব্বাস মিয়া (২৫) ও মিজান মিয়া (২২)। এর আগে গত বছরের ২ জানুয়ারি কোম্পানীগঞ্জের উটমা সীমান্তে খাসিয়াদের গুলিতে জৈন উদ্দিন নামের এক যুবক নিহত হন। তিনি উপজেলার বনপুর আদর্শ গ্রামের নুর মিয়ার ছেলে। জৈন আরো তিনজনকে নিয়ে সীমান্ত এলাকায় উটমা সীমান্তের ১২৫৭ নম্বর মেইন পিলারে কিছু কাঠ সংগ্রহ করতে যায়। এক পর্যায়ে ভারতীয় খাসিয়ারা তাদের ওপর গুলি চালালে ঘটনাস্থলেই জৈন নিহত হয়।
খাসিয়া জনগণ উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয়ের একটি জাতিগত গোষ্ঠী। সীমান্তবর্তী রাজ্য আসাম এবং বাংলাদেশের কিছু অংশে তাদের উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যা রয়েছে। খাসিয়ারা সম্প্রতি সীমান্ত পেরিয়ে কথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে পাহারা দল গঠন করেছে বলে জানিয়েছেন বনপুর আদর্শ গ্রামের একাধিক বসিন্দা।
এর আগে ২০২২ সালের ২৫ ডিসেম্বর জৈন্তাপুর উপজেলায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ভারত অংশে ‘খাসিয়াদের গুলিতে’ একজন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হন। মদসসির আলী (৫২) নামের ওই ব্যক্তি উপজেলার নিজপাট ইউনিয়নের গোয়াবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা। তখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, খাসিয়া পল্লী থেকে সুপারি চুরি করতে গিয়ে খাসিয়াদের গুলিতে নিহত হন মদসসির। নিজপাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইন্তাজ আলী তখন জানিয়েছিলেন, “সীমান্তবর্তী প্রায় প্রতিটি গ্রামেরই কিছু মানুষ চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত। অনেকে খাসিয়াদের গ্রাম থেকে বিভিন্ন জিনিস চুরি করেন। এ কারণে যে কেউ ভারতে প্রবেশ করলে খাসিয়ারা শত্রু মনে করে গুলি করে।”
একই দিনে জৈন্তাপুরের গুয়াবাড়ি সীমান্তে সালাম মিয়া নামে আরও এক যুবকের মৃত্যু হয়। সালাম জৈন্তাপুর উপজেলার গুয়াবাড়ি আদর্শ গ্রামের মছদ্দর আলীর ছেলে। রাতের কোনো এক সময় সীমান্ত এলাকায় সুপারি সংগ্রহে গিয়েছিলেন। এ সময় খাসিয়াদের একটি দল গুলি করলে তিনি মারা যান। এর আগে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলা সীমান্তে ভারতীয় খাসিয়াদের গুলিতে হারিছ আলী (২৫) নামে দোয়ারাবাজার সীমান্তের ঝুমগাঁও গ্রামের বুলু মিয়ার ছেলে মারা যান। তার কিছুদিন আগে কোম্পানীগঞ্জ সীমান্তের কাছে ভারতীয় খাসিয়াদের গুলিতে মন্তাজ আলী (২৭) আরও এক যুবক মার যায়। গুলিবিদ্ধ হয় তার দুই সহযোগী। মন্তাজ আলী নাজিরের গাঁও গ্রামের মৃত শুকুর আলীর ছেলে। একই ঘটনায় আরও তিনজন গুলিবিদ্ধ হন।
এমন মৃত্যু রোধে প্রশাসন কী পদক্ষেপ নিয়েছে জানতে চাইলে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গোলাম দস্তগীর আহমেদ বলেন, “আমরা নিয়মিত গ্রামবাসীকে এসব বিষয়ে সচেতন করি। কিন্তু মূল সমস্যা হলো দারিদ্রতা। এসব গ্রামের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত ও দরিদ্র। এই গ্রামগুলো সীমান্তের একেবারেই কাছে। ছোটবেলা থেকেই তারা এপারে-ওপারে গিয়ে অভ্যস্ত। আবার ওপারে খাসিয়া পল্লীগুলোতে এই মানুষগুলোর চাহিদাও আছে। তারা ওখানে গিয়ে কাজ করে অর্থ উপার্জন করে। সীমান্তের নো ম্যান্সল্যান্ডে কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচার হয় না। নিরপরাধ লোকদের লক্ষ্য করেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা গুলি ছুঁড়ে থাকে। এমনকি অপহরণের ঘটনাও কখনো কখনো ঘটে থাকে। সীমান্তে গুলি করে বাংলাদেশি বিজিবি সদস্যকে হত্যার ঘটনা ঘটুক কিংবা বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনা ঘটুক তখন বিজিবি কোনো তথ্য কিংবা সহায়তা করতে চায় না।
ভারতের সদিচ্ছার অভাবে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বা নির্যাতন কমছে না। বাংলাদেশের সীমান্ত বাহিনীর হাতে কখনো ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী কিংবা সাধারণ ভারতীয়রা নির্যাতিত হয় না। এমনকি হত্যার শিকার হয় না। বরং ভারতীয় বিএসএফ এর দ্বারাই বাঙালিরা হত্যার শিকার হয়, নির্যাতিত হয়। ভারতের দুর্গম গ্রামের মানুষ বাংলাদেশের হাটবাজারে এসে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী কিনে নিরাপদে বাড়ি চলে যাচ্ছে। বিষয়টি ওপেনসিক্রেট। মানবিক কারণে বিজিবি ও সাধারণ মানুষ দেখেও দেখে না। এটা কিন্তু বাংলাদেশের দুর্বলতা নয়, বরং সহানুভূতিশীলতা ও সহনশীলতা।