|| আহমদ ময়েজ ||
আমরা স্বাধীনতার পর থেকে কেবল শুনেই আসছি নির্যাতন বিষয়টি। কিন্তু এ নিয়ে বিচার হয়েছে বা কারোর শাস্তি হয়েছে, এমন কখনো শোনিনি। এর নিগূড় কারণ কী হতে পারে?
সংখ্যালঘু বিষয় নিয়ে সবচে সচেতন কারা ও কারা এ নিয়ে অধিক কথা বলেন? একদিকে, রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ ও বামসংগঠনগুলো। অন্যদিকে, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদ (অবশ্য এ সংগঠনে মুসলমান কেন নেই এমন বক্তব্য অনেকেরই। সে হিসেবে সংগঠনটি নিজেই অন্তর্নিহিত একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন)। আর রয়েছে শাহরিয়ার কবিরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। আরো আরো মানবাধিকার সংগঠন রয়েছে।
প্রশ্ন হলো এতো বড় বড় পাওয়ারফুল রাজনৈতিক, অ্যাকটিভিস্টরা সংখ্যালঘুদের পক্ষে থাকতে সাম্প্রদায়িক অপরাধের বিচারিক কার্যক্রমে এতো নিরুৎসাহ কেন রাষ্ট্রের? রানা দাস গুপ্তের একটি সাক্ষাৎকার মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলাম। গত ২০ আগষ্ট ২০২৪-এ ‘প্রথম আলো’তে ছাপা হয়েছে। রানা দাস গুপ্ত বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এবং তিনি একজন আইনজীবীও। সাক্ষাৎকারে যেসব প্রশ্নের উত্তর তিনি দিয়েছেন, সেসব কথাবার্তায় ছিলো অনেক কৌশল। বিচার সম্পর্কিত কোনো কথা তিনি উত্থাপন করেননি এবং ‘প্রথম আলো’র প্রশ্নকর্তা ব্যক্তিটিও সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন রাখেননি। এ ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিচার বিষয়টা একেবারেই গৌণ।
সংখ্যালঘু নির্যাতনের সংবাদটি কাদের বেশি উপকারে আসে অর্থাৎ কারা লাভবান হন? নিঃসন্দেহে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগই সব সময় লাভবান হয়। তাহলে কি সেই লাভের ফল নিজ ঝুড়িতে তুলে নিতেই এই সাম্প্রদায়িকতার লুকোচুরি খেলা তারা খেলেন? তাদের ১৬ বছরের শাসনামলে একটাও বিচারকার্য আমরা দেখিনি। রানা দাস গুপ্তদের এ বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ হতেও শোনিনি।
সাম্প্রদায়িকতা একটি ক্রাইম। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা একে ক্রাইম হিসেবে বিবেচনা করছেন বলে মনে হয় না। এর কারণ হিসেবে আমরা ধরে নিতে পারি, যদি সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এর বিচার কার্য পরিচালনা করা হয় তাতে দেখা যাবে, সংখ্যালঘুদের জমিজিয়ারত দখল প্রক্রিয়ায় বড় একটি ভূমিখোরদের দাবার ছকে বাধা রয়েছে। এই দখলদাররা সরকার দলে অন্তর্ভুক্ত। এরাই কৌশলে সাম্প্রদায়িক বয়ান হাজির করে বিষয়টিকে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বয়ান তৈরি করে। ধর্মীয় বিষয়টি সম্পৃক্ত করে যে ফ্রেইমওয়ার্ক বানানো হয় সেটা ছুড়ে দেয়া হয় মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর। আবার তারা কারা? তারা হলেন মোল্লামুন্সির দল। কিন্তু এদের কি কখনো দেখা গেছে তারা হিন্দুদের বাড়িজমি দখল করে বড় বড় দালান বাড়ি নির্মাণ করতে? সেসব নিয়ে কি কেউ তদন্ত করেছে? রানা দাস গুপ্তদের খেলাটা এখানেই। তারা এ বিষয়ে নীরব থাকেন। তাদের মিডিয়াবন্ধবসহ একই পর্যায়ের খেলোয়াড়ও বটে।
গত ৫ আগষ্ট ২০২৪-এর চিত্র একটু ভিন্ন হওয়ায় এই খেলোয়াড়রা অনেকটাই বিব্রত। কারণ, সকল শ্রেণীর মানুষ যখন প্রটেক্ট তৈরি করেছে যার যার অবস্থান থেকে, তখন ভূমিখোর ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা গর্তে থেকে চিৎকার করছে, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্প্রদায়িকতা বলে। কিছু জায়গায় দুর্বৃত্তরা সফলও হয়েছে। সেটুকু ঝুড়িতে তুলে নিয়েছেন রানা দাসরা। কিন্তু তবু রানা দাস গুপ্তের আফসুস থেকেই গেছে। তিনি ‘প্রথম আলো’কে বলেছেন, সংখ্যালঘুদের পাহারা দিতে হবে কেন? পাহারা কেন দিতে হবে সে প্রশ্ন নিজেকে করুন। সংখ্যালঘুরা বছরের পর বছর সুরক্ষায় থাকেন। প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাদের সংঘাত হয় না কিন্তু সেই সংঘাত আপনারা ক্রিয়েট করেন রাজনৈতিকভাবে। সেই বিশেষ মুহূর্তে পাহারা দিলে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা ব্যর্থ হয়ে যায়। তারা ব্যর্থ হোক এটা কি আপনি চান না রানা দাস গুপ্ত?
অন্যদিকে, মোদী সরকার বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়ে প্রচণ্ড রকম হাম্বিতাম্বি করছেন। তার বশংবদ মিডিয়াকে গুজব দিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ড: ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের একজন ড: রেজওয়ানা ভারতীয় মিডিয়াকে দৃঢ়ভাবে বলেছেন, হ্যা কিছু সাম্প্রদায়িকতার মতো ঘটনা ঘটেছে তবে সেটা বাবরী মসজিদের পর্যায় নয়।
গোজরাটের কসাইখ্যাত মোদীর কাছ থেকে কি আমরা বাঙালিরা সম্প্রীতি কাকে বলে শিখতে হবে? যে মোদী ভারতের গত নির্বাচনে ১৭৩টি বক্তৃতার মধ্যে ১১০টি বক্তব্য ছিলো সাম্প্রদায়িকতায় আবৃত। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের বাম-ব্যামোরাও একই সুরে কথা বলেন। আমরা এও জানি, বাংলাদেশে সরাসরি আরএস-এর জানবাজ কর্মী রয়েছে। তারা দীর্ঘদিন মাফিয়া সরকারের ছত্রছায়ায় লালিত-পালিত হয়ে আসছে। এ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ মারাত্মক সামাজিক, রাজনৈতিক ঝুকিতে রয়েছেন। এই গোষ্ঠী বাংলাদেশে মোদীবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারা এও মনে করে, বাংলাদেশ ভারতের অখণ্ড ভূমি। এসবকে উপড়ে ফেলে আমাদের সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে।
আমাদের এখন বড় দায়িত্ব হলো, সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে কোনো অভিযোগের বিষয়টি বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনা। রাষ্ট্র যেন এটাকে একটি জঘণ্য অপরাধ হিসেবে দেখে।
লেখক: বিলেতে বাংলা ভাষার প্রধান কবি; সাবেক সম্পাদক, সাপ্তাহিক সুরমা।