- ভয়াবহ বন্যায় ৫৮ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত
- ৩১ জনের মৃত্যু
লণ্ডন, ২৮ আগস্ট- ভারতের ছেড়ে দেয়া পানির ঢলে বাংলাদেশে আকস্মিক ভয়াবহ বন্যায় ফেনীসহ বাংলাদেশের ১১–১২টি জেলা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ভারতসৃষ্ট এ দুর্ভোগের কারণে বাংলাদেশে বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। মার্কিন সংবাদ সংস্থা সিএনএনের সাংবাদিকদের একটি দল সরেজমিনে বাংলাদেশের দক্ষিণ–পূর্বের শহর ফেনীর বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে এক ডজনের বেশি মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে। ফেনীর বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, ‘ভারত সরকার কোনো ধরনের সতর্কবার্তা না দিয়েই গোমতী নদীর ওপরে থাকা ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দিয়েছে।’ সিএনএনের প্রতিনিধিরা বন্যাদুর্গতদের বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কেউ কেউ চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমরা ভারতকে ঘৃণা করি। এটা ভারতের পানি। তারা কোনো খবর না দিয়েই গেট খুলে দিয়েছে। ভারত পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। সর্বশেষ সরকারকে উৎখাত করার প্রতিশোধ নিচ্ছে তারা। এর মধ্যে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি রয়েছে।’
বাংলাদেশে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা শুরুর পর থেকেই ভারতের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল উঠছে। ডুম্বুর ও ফারাক্কা বাঁধ খুলে দিয়ে রীতিমত অঘোষিত জলযুদ্ধ ঘটিয়েছে ভারত। যদিও বিভিন্ন বিবৃতি ও মন্তব্যের মাধ্যমে দায় এড়িয়ে গেছে দেশটির সরকার। তবে বাংলাদেশে এমন আকস্মিক বন্যা আন্তর্জাতিক মহলের নজর কেড়েছে। বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশ করেছে বিশ্ব গণমাধ্যম। যার মাধ্যমে আলোচনায় ছিলো ভারতের পানি নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতার নানা চিত্র। তবে ভারতের একাধিক গণমাধ্যম বাংলাদেশের বন্যায় ভারতের দায় কে নানাভাবে অস্বীকার করতে থাকে। বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতির জন্য ভারত দায়ী নয়- এই মর্মে একের পর এক সংবাদ প্রকাশ করতে থাকে দেশটির বিভিন্ন গণমাধ্যম।
কিন্তু এবার বাংলাদেশের বন্যার জন্য সরাসরি ভারতকেই দায়ী করলো জাতিসংঘ। সম্প্রতি জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্রের কার্যালয়ের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে উঠে আসে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি। বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাওয়ায়, প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরুর আগেই বাংলাদেশের বন্যা নিয়ে মন্তব্য করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি পড়ে শোনানো হয়। বাংলাদেশের বন্যা প্রসঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, ভারী বৃষ্টি ও ভারত থেকে আসা উজানের ঢলে বাংলাদেশ আকস্মিক বন্যার কবলে পড়েছে। জাতিসংঘের দল দুর্গত এলাকায় আছে। তারা দুর্গত মানুষের মধ্যে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখার কিট ও খাবার বিতরণ করছে। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় ও মৌসুমি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য প্রথমবারের মতো মানবিক সহায়তা পরিকল্পনা গত মাসে চালু করেছে মানবিক কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংস্থাগুলো। এর লক্ষ্য ১২ লাখ মানুষকে সহায়তা করা। এখন পর্যন্ত প্রায় সাত লাখ মানুষের কাছে তারা সহায়তা পৌঁছাতে পেরেছে।
জাতিসংঘের এমন বিবৃতির পর গলার স্বর কিছুটা নামিয়েছে ভারত সরকার। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে ফারাক্কা ব্যারেজের গেট খুলে দেওয়া নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা এটা স্বীকার করেছেন, বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া ও যোগাযোগব্যবস্থা ধসে পড়ায় ভাটিতে থাকা প্রতিবেশীদের জন্য সাধারণত যে সতর্কতা জারি করা হয়, তাঁরা এবার তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা ফারাক্কা বাঁধের গেট খোলার বিষয়ে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখেছি। এতে বলা হয়েছে, নদীর স্বাভাবিক গতিপথে ১১ লাখ কিউসেক পানি প্রবাহিত হবে। বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও প্রচার করে বাড়তি ভয় বাড়ানো হচ্ছে। আসলে এটি স্বাভাবিক মৌসুমি প্রক্রিয়া, উজানে গঙ্গা নদীর অববাহিকায় ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে পানির প্রবাহ বেড়ে যায়।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই মুখপাত্র বলেন, ‘প্রটোকল অনুযায়ী, নিয়মিত ও সময়মতো ফারাক্কা ব্যারেজের ডেটা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট যৌথ নদী কমিশনের কর্মকর্তাদের প্রদান করা হয়। এবারও তা করা হয়েছে।’
ভারতের ছেড়ে দেয়া পানির ঢলেই বাংলাদেশে সাম্প্রতিক প্রবল বন্যায় ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, সিলেট সহ দেশের মোট ১১ টি জেলা আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি জেলায় মোট ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এছাড়াও বন্যায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৮ লাখ ২২ হাজার ৭৩৪ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বন্যায় মৃতদের মধ্যে কুমিল্লার ১২ জন, ফেনীর ২, চট্টগ্রামের ৫, খাগড়াছড়ির ১, নোয়াখালীর ৬, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার ১, লক্ষীপুরের ১ ও কক্সবাজারের ৩ জন। মৌলভীবাজারে দুই ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন।
দেশের সাম্প্রতিক বন্যায় ১২ লাখ ২৭ হাজার ৫৫৪টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের জন্য ৪০০৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয় নিয়েছেন ৫ লাখ ৪০ হাজার ৫১০ জন। এছাড়াও ৩৯ হাজার ৫৩১টি গবাদি পশুকে রাখা হয়েছে। ১১টি জেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা দিতে ৬১৯টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে। এছাড়া দেশের সব জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী মজুদ রয়েছে বলে জানিয়েছে ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সরকারি-বেসরকারিসহ সব পর্যায় থেকে ত্রাণ বিতরণ চলছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সংগ্রহ করা ৮৮ হাজার ৫০০ প্যাকেট শুকনা খাবার, কাপড় ও পানি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের (ডিডিএম) মাধ্যমে বন্যাকবলিত এলাকায় পাঠানো হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর (ডিডিএম) ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে।
এছাড়া বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোর জেলা প্রশাসকদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, মেডিকেল টিম ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে এক সঙ্গে কাজ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।