।। আবদুস সেলিম ।।
জ্যাক হির্শম্যানের জন্ম ১৯৩৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর নিউ ইয়র্ক শহরে, যে শহরটিকে নিয়ে তিনি অসামান্য একটি কবিতা লিখেছেন বহু বছর পর। একেবারে ১৮/১৯ বছর বয়সেই তিনি যোগ দিযেছিলেন নিউ ইয়র্কের Associated Press নামক এক সংবাদ সংস্থায়। সে সময়ই আর্নেস্ট হোমিংওয়ের অনুকরণে লিখছিলেন গল্প। হোমিংওয়ের অভিমত জানার জন্য তিনি তখন দুটি গল্প পাঠিয়েছিলেন। হেমিংওয়ে সঙ্গে সঙ্গে চিঠি লিখে যা জানালেন তা বিরোধাভাসে উজ্জ্বল এক ভাষ্য: “ I can’t help you, kid. You write better than i did when i was 19. But the hell of it is, you write like me. That is no sin. But you won’t get anywhere with it.” এই চিঠি পাওয়ার পর জ্যাক হেমিংওয়ের অনুকরণ তো বর্জন করলেনই, এমন কি গল্প লেখাও ছেড়ে দিলেন, যদিও পরবর্তীকালে তার কবিতায় গল্পের আখ্যানধর্মী বৈশিষ্ট্য বারবারই এসেছে, এসেছে অসামান্য দক্ষতায়। জ্যাককে লেখা হোমিংওয়ের ওই চিঠির একটা কপি থেকে গিয়েছিল তার কর্মক্ষেত্র এসোসিয়েটেড প্রেসেই। আর ১৯৬১ সালে হেমিংওয়ে যখন আত্মহত্যা করলেন তখন ওই চিঠিটাই এসোসিয়েট প্রেস “Letter to a young Writer.” শিরোনামে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিল বিরল সংগ্রহ রূপে।
এই চিঠির সুবাদে জ্যাক হির্শম্যান অনেকেরই মনোযোগের কেন্দ্রে চলে আসেন। জ্যাকের জীবনে আরেকটি বড় ঘটনা ভিযেতনাম যুদ্ধ। ৫০ ও ৬০ এর দশক তিনি অধ্যাপনা করেছেন ডার্টমাউথ কলেজ এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস এঞ্জেলস (UCLA)-এ। এই অধ্যাপনা জীবনে তিনি The Doors-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং লিড ভোকালিস্ট জিম মরিসনকে পেয়েছেন ছাত্র হিসেবে। অধ্যাপক হিসেবে জ্যাক-এর সুনাম ছিলো গোটা ক্যাম্পাসেই। এই সফল পেশাটিও তাকে ছাড়তে হয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন সরকারের বিরোধিতার কারণে। কবি ডেভিড মেল্টজার-এর ভাষায় হির্শম্যান ছিলেন “ A great teacher who refuses to work in the university, a scholar of great merit who refuses to publish in the mainstream presses. ” সততা ও আদর্শনিষ্ঠা তাকে সুবিধা গ্রহণে বিমুখ করেছে বটে কিন্তু সেটাই তাকে দিয়েছে চরিত্রের এমন এক বৈশিষ্ট যা তাকে গৌররান্বিত করেছে মনুষ্যগুণে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে শিক্ষকতা পেশা হারারার পর তিনি আর কখনোই অন্য কোনো পেশায় যুক্ত হননি। এরপর থেকে পূর্ণ সময় তিনি নিয়োগ করেছেন লেখালেখি, প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের অব্যাহত কর্মকান্ডে। ইতিমধ্যে তার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। পাশাপাশি রযেছে বিপুল পরিমাণ অনুবাদ ও সম্পাদিত গ্রন্থ। বর্ণমালাভিত্তিক শিল্পচর্চার পাশাপাশি জ্যাক রংয়ের রাজ্যেও সমানভাবে সক্রিয়। চিত্রশিল্পী ও কোলাজ শিল্পী হিসেবে জ্যাকের পরিচিতি কম নয়। জার্মান, ফরাসি, স্প্যানিশ, ইতালিয়, রুশ, আলবেনিয় এবং গ্রীক ভাষা খেকে ইতিমধ্যে গোটা পঁচিশেক বই অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন। তার অনূদিত ও সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে নেরুদা, আন্তোনিন আর্তো, পিয়ের পাওলো পাসোলিনি, রোকে দাল্তন এবং বামপন্থী লেখক শিল্পীদের প্রবন্ধের বই Art on the line.
মূল: The Twin Towers Arcane by Jack Hirschman, ভাষান্তর: আবদুস সেলিম
১.
এমন শোক থেকে
যদি জেগে উঠতে পারতাম সবাই
(সেই বিশাল আলোর ঝলকানিতে ঘুমভেঙ্গে)
আলোক বর্তিকা দেখে
সব কিছু শেষ হলে:
যেন আমরা এখন
বেশিও নই
কমও নই
অথচ সবসময়ই সবার চাইতে অনেক বেশি
হিংস্র এক দেশ
আমাদের অর্থবাজারে
আমাদের আইনশৃঙ্খলায়
আমাদের প্রতিদিনের দৈনিকে
আমাদের শয্যায়
এক হিংস্র জীবন যাপন
ভান করা এক গহন সরলতা
পেশি-প্রতীকের প্রদর্শন
দানবীয় ঐ
দুই টাওয়ারে।
তাদেরই বিনষ্টি:
হিটলারের স্বপ্ন, যে স্বপ্ন দেখেছিল সে
ঐ টুইন নির্মাণের অনেক আগে।
আর আমরা
যারা উত্তরাধিকার পেয়েছি
তার সহিংসা আর সাম্যবাদ-বিরোধিতার,
আমরা যারা অবশেষে
অর্থ জোগান দিয়েছি দ্বন্দ্বে
ভান করা এক সরলতার আশ্রয়ে
-আমরা এতই নিরুদ্বেগ ফ্যাসিবাদ নিয়ে (অস্বীকার করি যদিও)
হিংস্রতা নিয়ে (মিথ্যা শপথ করি যদিও)
আবেগ-আক্রান্ত স্বাধীনতা নিয়ে
গহিন ধংসাত্বক শূন্যতা নিয়ে,
নৈরাশ্য নিয়ে,
যার অতলে নেতিবাদের বসবাস,
তারা-খচিত অপত্যরা যত
যাদের শুধু নাস্তিবাদের ছলচাতুরীতে আশ্রয়
“সেই ক্যালিফোর্নিয়া থেকে
ন্যু ইয়র্ক দ্বীপ পর্যন্ত”
ভাই ও বোনেরা,
আমারই আপনজন সব,
বিষণ্ণতার কষাঘাতে
কি নিদারুণ প্রহৃত সবাই।
২.
ইসরাইলিটা বলে, “এখন বুঝুক তারা”
যে নিজেই আক্রান্ত
নিজ বংশানুগত অমোঘ উপাদানে
এক যুগ
প্রসারিত পাপাচারের সিঞ্চনে।
অনুমেয় ভাবে আমরাই এখন বুঝি
চরম ঘৃণার গভির অর্থ
যা পৌঁছে দেয় মহাপ্রলয়ের চূড়ায়।
এ এক ফ্যাসিবাদী অজুহাত
আর এক ফ্যাসিবাদী হামলার বিরুদ্ধে
যার প্রস্তুতি নিচ্ছে এই পৃথিবী, কারণ
চারিদিকে তো শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নেই
এ যেন এক বৃশ্চিক-গ্রহ গিলে খাচ্ছে
তার আপন পুচ্ছ;
আর সেই সত্যের সচেতনতা
দ্বিগুণ করে শোকের মাতমকে
ভয়কে করে গভীর-গভীরতর
কারণ সকল সরলতা আজ বিসর্জিত
সেই সরলতা যা ছিল শুরু থেকেই মেকি।
এবার আমরা আটক হয়েছি বেশ
সত্যের ফাঁদে
যে ফাঁদ আমাদের দিচ্ছে প্রচণ্ড পীড়া
আমরা যারা ছিলাম স্বচ্ছন্দ
মিথ্যা মুক্তির আশ্রয়ে এতদিন।
এবার যুদ্ধের সকল
উদ্যোগ-সচেতনতা জানান দিচ্ছে:
যদি শান্তিবাদ প্রসারিতও হয়,
যদি হামলার প্রত্যাঘত নিরুৎসাহিত হয়,
যদি অহিংসবাদের জয়ই হয়,
তবু ভবিষ্যৎ হবে
একজন কালো মানুষের মতো, যাকে
বিনাবিচারে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয় বা
কামাবেগ-চেতনার মতো, যা
অশ্লীলতার দায়ে করা হয় নিয়ন্ত্রণ,
শান্তিবাদ, সহনশীলতা, অহিংসা
কখনই নিরাপদ নয়
এই পার্থিব বিশ্বে।
অসারতার নিয়মবিধি
আজ সম্পূর্ণ, সম্পন্ন।
ঈশ্বরকে এক দিকে করা হয়েছে হত্যা
অন্যদিকে ঈশ্বর নিজেই করেছে আত্মহত্যা
একেই বলে ফ্যাসিবাদের বিজয়।
আমরা আজ নির্দেশিত
অহিংস জীবনযাত্রায় ইতি টেনে
হিংসার বেচাকেনার চর্চায় নিমগ্ন হতে
হিংসার আরাধনাকে বাঁচিয়ে রাখতে,
আপনকে অতিক্রম করে
কারণ আর কোনো বিকল্প আমাদের নেই,
কিছুই বদলায়নি,
হিংসাই তো দাঁড়িয়ে আছে নগ্ন প্রকাশে।
৩.
সেলিয়া,
আমি জানি তুমি ছুটে এগিয়েছিলে,
ছুটে পালাওনি,
সাহায্যের হাত বাড়াতে, বাঁচাতে।
তুমি দৌড়তে-দৌড়তে দেখেছিলে
দ্বিতীয় বিমানটা কেমন বাষ্পীয় হয়ে
ঢুকে গেল দেয়ালের ভেতর।
আরও দেখেছিলে,
যা ছিল তোমার জীবনের প্রথম দেখা,
কিভাবে মানুষ ঝাঁপিয়ে নিচে পড়ে
উঁচু জানালর আলসে থেকে
আর টুইন তখন ধ্বসে পড়ছিল
হাজারহাজার মৃত
মানুষের পাহাড়-স্তূপ হয়ে
খোলামকুচি আর ধূলিকণার মত।
আমি এসব দেখেছি
টেলিভিশনের পর্দায়
সহস্র যোজন দূরে
আর এক মহাদেশ থেকে
আর তুমি দেখেছ ছুটছুটতে তোমার নিজ চোখে
সেই বিভীষিকার রূপ
আমার দেখার সাথে সে তো তুল্য নয় কোনভাবে।
তারপর তুমি আর দেখতে পাওনি
চারধারের ধুলো-মেঘ যখন
ছড়িয়ে পড়েছিলো রাস্তার আনাচেকানাচে
মানুষ প্রাণ বাঁচাতে হয়েছিল মরিয়া
বলেছিল সবাই, আর এগিয়ো না
যেওনা কাছে, কিছুই করার ছিলনা তোমার,
বাঁচাতে পারনি কাউকে, আমার প্রিয়
সাহসিকা, অসীম সাহসিকা মেয়ে।
আমি জানি তোমার অনুতাপ
ছিলনা তোমার কাছ থেকে দূরে সরে।
সবারই হয়েছিল নিষ্ফল, একেবারে নিষ্ফল জীবনপাত!
তোমার সেই কান্না
আর তোমার সেই কষ্ট সম্ভবত
আমাদের সবার সহ্যকে আজও এগিয়ে নেয়,
এমনকি আমাদের প্রচণ্ড মানসিক আঘাতকে
করে প্রশমিত
সেই সহ্য, সেই আঘাত সময়ে আজ
হয়ে গেছে পুরাতন এক প্রত্নতাত্মিক খনন।
৪.
আজকের রাত, সে তো প্রযুক্তির রাত, আলোময় দিন এক,
তার সাথে গাথা আছে শোক,
গতির গতিময়তা
আর নিজের মিষ্টান্নের স্বাদ
আজ তিক্ততায় ভরা।
এ শুধু আমাদের একার নয়
আমরা আজ সবাই কচকচে বালুকণা মুখে পুরে কথা বলি,
দূর থেকে এক বালিয়াড়ি ছুটে আসছে,
সংলাপের তরঙ্গে তরাঙ্গায়িত হচ্ছে এক চোখ-ধাঁধানো অন্ধকার
সূর্যকে ঘিরে, যার অস্তিত্ব আমাদের প্রত্যেকের গভীরে।
সারা রাতভর বিমান আর হেলিকপ্টার উড়েছে
বলোনিয়ার রক্তিম পোড়া মাটির পোর্টিকোতে,
আমি তখন সেখানে শোকের অবগাহনে
শোকই হয়েছে আমার
স্থায়ী বাসস্থান।
এক কালো পতাকা
অর্ধনমিত।
ঝুলে আছে বাতাসের মাঝে।
রচনাকাল: ২০০১