দীর্ঘ বন্ধের পর খুলেছে রাজধানীর মার্কেট, শপিংমল ও বিপণি বিতানগুলো। খুলেছে ছোট-বড় দোকানপাট। কিন্তু গত এক মাসে ব্যবসায়ীরা হতাশ। ক্রেতাশূন্য মার্কেটে গল্প গুজবে দিন কাটে ব্যবসায়ীদের। সবচেয়ে বেশি দৈন্যতায় রয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তারা এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছেন। এসব ব্যবসায়ীরা ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখকেন্দ্রিক ব্যবসা করতে পারেন নি। এতে চরম ক্ষতির মুখে পড়েন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা।
ঈদুল ফিতরের পর সীমিত পরিসরে ব্যবসায় ফিরলেও ক্ষতিগ্রস্ত এসব ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দোকানপাট খোলা হলেও নেই আগের মতো বেচা-বিক্রি। এতে লাভ তো দূরের কথা বরং প্রতিদিন লোকসান গুনতে হচ্ছ। করোনা সংক্রমণের ভয়ে একদিকে ক্রেতা কম। অন্যদিকে অর্থিক সংকটে চাহিদা অনুয়ায়ী দোকানে পণ্য উঠাতে পারছেন না। ফলে দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারীদের বেতনসহ ইত্যাদি খরচ নিয়েই চিন্তিত ব্যবসায়ীরা। বেশকিছু দিন ব্যবসা বন্ধ থাকায় কমে গেছে তাদের আর্থিক সক্ষমতা। পুঁজি হারিয়ে ইতিমধ্যেই অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। শহরে টিকতে না পেরে চলে গেছেন গ্রামে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পরিবার নিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। সরকার ঘোষিত প্রণোদনার আওতায় ব্যাংক থেকেও ঋণ পাচ্ছেন না। কারণ স্বল্প পুঁজির এসব ব্যবসায়ীদের অধিকাংশরই ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নেই। যদিও ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের শীর্ষস্থানীয় সংগঠনগুলোর সুপারিশও রয়েছে। কিন্তু ব্যাংকে ধর্না দিয়েও মিলছে না কোনো প্রকার অর্থ। এ অবস্থায় চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এসব স্বল্পপুঁজির ব্যবসায়ীরা। তবে বিকল্পভাবে হলেও ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহযোগিতার কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা। অন্যথায় দেশের আর্থসামাজিক অবস্থায় আরো বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে মনে করেন তারা।
রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় ব্যাগ ও চামড়াজাত পণ্যের ব্যবসা করেন আমির হোসেন। সাধারণ ছুটির সময় ব্যবসা বন্ধ করে বাধ্য হয়ে গ্রামে চলে যান। তার ভাষ্যমতে, ব্যবসা বন্ধ থাকায় এতদিন সঞ্চয় করা টাকাগুলো খরচ করতে হয়েছে। এখন ব্যবসা শুরু করলেও বিক্রি নেই। এদিন দুপুর গড়িয়ে গেলেও ক্রেতার দেখা পাননি তিনি। আগে তার দোকানে ৩-৪ জন কর্মচারী কাজ করতো, এখন একজন কর্মচারীর বেতনসহ অন্যান্য খরচ মেটাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। খেয়েপরে বেঁচে থাকাই দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় কোনো প্রকার অর্থিক সহযোগিতাও মিলছে না। শুধু আমির হোসেন নয়, তারমতো অনেক ব্যবসায়ীর অবস্থা এখন এমনই। আর তার চেয়ে ছোট ব্যবসায়ী যারা, তাদের অবস্থা আরো শোচনীয়। অনুসন্ধানে রাজধানীর নিউ মার্কেট, শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট, মেট্রো শপিং, স্টার্ন প্লাজাসহ বেশ কয়েকটি মার্কেট ও বিভিন্ন এলাকার অন্তত ১২-১৫ জন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে এমনটিই জানা গেছে। এদের মধ্যে রয়েছে জুতা ব্যবসায়ী, পাঞ্জাবি, বোরকা, প্যান্ট-শার্ট, ঘড়ি, হাঁড়ি-পাতিল ও গৃহস্থালি জিনিসপত্রসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী। সরজমিনে এসব মার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, ক্রেতা না থাকায় বিক্রেতারা অবসর সময় পার করছেন। এমনকি বসুন্ধরা শপিংমল যেখানে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় থাকে, সেখানকার বিক্রেতারাও ক্রেতা না থাকায় হতাশা প্রকাশ করেন। এসব দোকানে আগে ৪-৫ জন করে কর্মচারী কাজ করতো। এখন সেখানে একজন মাত্র বিক্রয় কর্মী কাজ করছেন। ফ্যাশন জোনের ওহাব উদ্দিন বলেন, গত ঈদ ও পহেলা বৈশাখে বিশাল ক্ষতি হয়ে গেছে। এখনো ক্ষতির মধ্যেই রয়েছি। দোকানে বিক্রি হবে, আবার মাল উঠাবো এটিই সিস্টেম। কিন্তু কোনো ক্রেতা নেই, বিক্রিও নেই। ব্যবসা বন্ধ থাকায় আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে সেটা পুষিয়ে উঠবে কীভাবে?
সবচেয়ে খারাপ অস্থায় রয়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এদের অনেকেই পুঁজি হারিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে। এমনই একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শাহিন খন্দকার। রাজধানীর রায়ের বাজার এলাকায় ছোট একটি দোকান ভাড়া নিয়ে ঘড়ির ব্যবসা করতেন। ব্যবসা বন্ধ থাকায় সঞ্চয় করা টাকা এতদিন খরচ করতে হয়েছে। পুঁজি না থাকায় দোকানে নতুন করে পণ্য ওঠাতে পারেননি। স্টকে থাকা পণ্যও বিক্রি হচ্ছে না। সারা দিন বসে থেকেও ক্রেতার দেখা মিলছে না। এ অবস্থায় ভাড়া দিতে না পারায় দোকান ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বলেন, চিন্তা করেছি দোকান ছেড়ে দিয়ে স্টকে থাকা মালগুলো রাস্তায় কোথাও বসে বিক্রি করবো। তা ছাড়া আর উপায় দেখছি না। খরচ মেটাতে না পারায় স্ত্রী সন্তানকে গ্রামে রেখে এসেছি। সেখানে থাকলেওতো খাবার খেতে হয়। আমি টাকা না পাঠালে তারা খাবে কী? তাই আর ভালো লাগছে না। কাছের অনেকেই গ্রামে চলে গেছে। আমারও হয়তো সেটিই করতে হতে পারে। গ্রামে গিয়ে ক্ষেত-খামার করে কোনমতে বেঁচে থাকা যাবে হয়তো।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির দেয়া তথ্য মতে, সাধারণ ছুটিতে দোকানপাট বন্ধ থাকায় প্রতিদিন গড়ে ১১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। যা গত ৬৪ দিনে (২৬শে মার্চ থেকে ৩০শে মে) লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকা। শুধু পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে মাটির হাঁড়ি, মিষ্টি, পোশাকসহ দেশের বাজারের জন্য শতভাগ পণ্য তৈরি করে এমন ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ আরো ৬ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৭৬ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, আমরা যে পরিসংখ্যান দিচ্ছি এটা কিন্তু মনগড়া কোন পরিসংখ্যান নয়। প্রথমত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আসলে কারা? মূলত ১৫ জন এবং তার কম কর্মচারী নিয়ে যারা ব্যবসা করেন তাদেরকে আমরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ধরে থাকি। দেশে এই ব্যবসায়ীদের ৫৬ লাখ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ৫৬ লাখ প্রতিষ্ঠান যদি গড়ে ২০ হাজার টাকাও সেল করে, আর যদি ১০ পার্সেন্ট প্রোফিট ধরেন, তাহলে ব্যবসা বন্ধ থাকলে গড়ে প্রতিদিন ১১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হওয়াটা স্বাভাবিক। এই বিশাল ক্ষতির বোঝা মাথায় নিয়ে তাদের বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সেখানে ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোটা আরো বেশি কঠিন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। বিপুল পরিমাণ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অবশ্যই সরকারের সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমরা দেখলাম সরকার একটি গতানুগতিক বাজেট দিয়ে দিলো। এই বাজেটে এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কিছু পাবে না। তবে যে প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে ব্যবসায়ীরা দাঁড়াতে পারতেন। কিন্তু ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ দিবে না। এ অবস্থায় তাদেরকে নানা বিপদ চারিদিক থেকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরেছে। এমনিতেই তারা কর্ম হারিয়ে দিশেহারা। এরমধ্যে আবার বিদ্যুৎ বিল, পানির বিলসহ যাবতীয় খরচ বাড়ানো হয়েছে। এতে প্রতিদিন মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে। গ্রামে গিয়ে কী করবে? সেখানেও হতাশা। এসব অসহায় মানুষের পাশে সরকার যদি এগিয়ে না আসে, রাষ্ট্র যদি তাদের সাপোর্ট না দেয়, তাহলে কিন্তু তাদের জন্য এই দুর্যোগের সময় বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়বে।
হেলাল উদ্দিন আরো বলেন, সবচেয় খারাপ অবস্থায় পড়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। প্রায় ৬০ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে ফেরি করে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করেন। রাস্তায়-ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ব্যবসা করেন। এদের পুঁজির পরিমাণ বেশি হলে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে গত ৩-৪ মাস বসে থেকে তাদের পুঁজিও খেয়ে ফেলেছে। এখন এই ৬০ লাখ পরিবার কী করছে? তারা তাদের পরিবার নিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। কাজকর্ম নেই হতাশায় দিন কাটাচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে যদি তাদের পুঁজির ব্যবস্থা না হয় তাহলে তারা কাজে ফিরতে পারবে না। আর এই মানুষগুলো কাজে না ফিরলে দেশে সামাজিক নানা সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
তিনি বলেন, তারা যেন সহজে আর্থিক সহায়তা পায় সেজন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে যারা ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে থাকে, যেমন দেশে বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, গ্রামীন ব্যাংক রয়েছে, ব্র্যাক, প্রশিকা, আশাসহ অনেক এনজিও আছে। এদের মাধ্যমে যদি সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হতো তাহলে দ্রুত তারা কাজে ফিরতে পারতো। কারণ আমাদের দেশে ব্যাংকগুলো দানবীয় আকারে গড়ে উঠেছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হলো বড় বড় ব্যবসায়ীদের। এদের দ্বারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সহযোগিতা পাবে না। তবে ন্যাশনাল আইডি কার্ড জামানত হিসেবে রেখে তাদের জন্য প্রণোদনার আওতায় ঋণের ব্যবস্থা করলে তারা দ্রুত কাজে ফিরতে পারবে। এটা সরকারকেই ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, নতুন অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে কর্পোরেট কর কমানোসহ বেশ কিছু সুবিধা দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ওপর ১৫ শতাংশ মূসক আরোপ করা হয়েছে। যা একেবারে অযোক্তিক। যেখানে এই দুর্যোগের সময় ব্যবসা করাই দায় সেখানে এমন সিদ্ধান্তের ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা আরো হুমকির মুখে পড়বে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে তাদের বিরাট ক্ষতি হয়েছে এটা সত্য। তারা দ্রুত ব্যবসায় ফিরতে পারছে না। এটি একটি মানবিক এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের জন্য সরকার ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ক্রেডিট লাইন দিয়েছে। কিন্তু এখানে সমস্যা হলো এই ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগই অপ্রাতিষ্ঠানিক। ব্যাংকের সঙ্গে তাদের লেনদেন নেই। সেজন্য আমরা বলছি যে এদের জন্য ঋণ সুবিধাটা যেন সহজ করা হয়। কিন্তু যেহেতু একটা ক্রেডিট চালু করে দিয়েছে এটা আদায় করে নেয়ার দায়িত্ব তাদের। আর ব্যাংকিং সেক্টরের যে সমস্যা আমরা দেখছি, তারা খুব স্লো, ঋণ প্রদান করার ক্ষেত্রে তাদের একটা অনীহা থাকে। কারণ তারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের চিনে না। কিন্তু এখানে এসোসিয়েশনগুলো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। সে ক্ষেত্রে দোকান মালিক সমিতি আছে তারা তাদের সহযোগিতা করতে পারে। যদিও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের যে সংখ্যা সেই তুলনায় এই ২০ হাজার কোটি অপ্রতুল। তবু এদের যে এসোসিয়েশন রয়েছে তাদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঋণের ব্যবস্থা করতে পারে। বিকল্পভাবে হলেও কোনভাবে তাদের ঋণ সুবিধা দেয়া যায় কি-না তা ভাবতে পারে। তাছাড়া সরকারের ঋণ ভিত্তিক কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের জন্য যদি পুঁজির ব্যবস্থা করা যায় তাহলে তারা দ্রুত ব্যবসায় ফিরতে পারবেন। মানবজমিন