- আনোয়ারুজ্জামানের বড় ভাই ও মামা ছিলো রাজাকার : মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার
লণ্ডন, ২৫ আগস্ট- প্রফেসর ড. ইউনুসকে হামিদ কারজাই ও নিজ দল আ‘লীগকে তালেবানের সাথে তুলনা করে আবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরে আসার ঘোষণা দিলেন সিলেটের বহিস্কৃত সিটি মেয়র ও শেখ রেহানা ঘনিষ্ঠ আনোয়ারুজ্জান চৌধুরী।
জুলাই গণহত্যার দায়ে সিলেটের আদালত ও বিভিন্ন থানায় পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে। এসব মামলায় পাঁচটিতে আনোয়ারুজ্জামানকে অন্যতম আসামি করা হয়েছে। গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত আনোয়ারুজ্জামান দেশ থেকে লণ্ডনে পালিয়ে এসে আত্মগোপনে থেকে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন। শনিবার, ২৪ আগস্ট নিজের ফেসবুক পেজ থেকে লাইভে এসে ১৮ মিনিট কথা বলেছেন পাঁচটি গুরুতর অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হওয়া আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। লাইভে তিনি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কড়া সমালোচনা করেন।
ফেসবুক লাইভে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমান সরকার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। তারা বাংলাদেশকে জিম্মি বানিয়েছে। সারা দেশে লাখ লাখ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলা হয়েছে। বাংলাদেশে কখনও এমনটি হয়নি। আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করছে। পুলিশকে হত্যা করছে। পুড়িয়ে মারছে। বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের শিক্ষকদের বেইজ্জতি করছে। এসব নির্যাতনের বিচার একদিন বাংলাদেশে হবে। হামিদ কারজাই ড. ইউনুসকে তারা ক্ষমতায় বসিয়েছে। হামিদ কারজাই ড. ইউনুস জোর করে ক্ষমতা দখল করেছে। হামিদ কারজাই ড. ইউনুসকে একদিন বিদায় নিতে হবে। আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘শেখ হাসিনা এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি পদত্যাগ করেননি। তাকে জোর করে দেশছাড়া করা হয়েছে। তিনি (শেখ হাসিনা) অচিরেই বাংলাদেশে ফিরবেন।’
দেশ থেকে পালিয়ে এসে আত্মগোপনে থেকে আনোয়ারুজ্জামান কিভাবে এত বড় বড় কথা বলছেন এবং গণহত্যার সাফাই গাইছেন তা শোনে মানুষ বিস্মিত হয়েছেন। দেশে থাকতে যিনি বালাগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সমাজসেবা সম্পাদকের বেশি এগুতে পারেননি। সেই তিনি কিভাবে স্থানীয় সকল হেভিওয়েট প্রার্থীকে ডিঙিয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র প্রার্থী হিসেবে দলীয় নমিনেশন পেয়েছিলেন এবং এতগুলো গুরুতর অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে তিনি কিভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ও বিজয়ী হয়েছিলেন সেটা ভেবে মানুষ আজও বিস্মিত। কিভাবে তিনি শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠ হলেন এবং কিভাবে তিনি ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আইএফআইসি ব্যাংক পিএলসির পরিচালক ছিলেন, কিভাবে এত বিত্ত-বৈভবের মালিক হলেন, কোথায় আলাদিনের চেরাগ পেলেন এসব ভেবে তাদের বিস্ময়ের ঘোর যেনো কাটছেই না। দেশে বসবাসরত মানুষ অবিলম্বে তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের দাবি তুলেছেন। এছাড়া যারা তাকে পালিয়ে আসতে সাহায্য করেছেন, তাদেরকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনার, বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন।
ফেসবুক লাইভে এসে চরম উত্তেজিত আনোয়ারুজ্জামানের ভিডিও বক্তব্যে শোনে নেটিজেনরা বিরুপ মন্তব্য করেছেন, মো: শহিদুল নামে একজন লিখেছেন, ‘মাগনা পাওয়া ক্ষমতা হারিয়ে তুমি পাগল হয়ে গেছো। তুমি পাগলের বুলি বলতেছ! তোমাকে পাবনায় পাঠানো দরকার।’ মিনারা করিম নামে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘জবানে তেজ হইছে, দেশে এসে বুঝিয়ে বলো। দুরের কথা আমরা বুঝতে পারছি না। দেশে আসো তোমার সাথে একটা সেল্ফি তুলবো।’ মইনুল ইসলাম চৌধুরী নামে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘দেশ থেকে পলায় গিয়া গলা বড় হয়ে গেছে। দেশও আইয়া মাতো। দেশে আহ বাতিজা।’ ময়মুন্নেছা চৌধুরী নামে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘তুমি মিয়া ভূয়া নির্বাচিত, চান্দু সিলেটে আসো।’ সানি নামে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘তুমি এত বালা মানুষ,দেশ তাকি গেলায়গিকেনেবা তাক লায়না কেনে দেশে।’ সুলতান আহমেদ নামে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘তুমি দেশে আসো চান্দু। ছাত্র-ছাত্রী, শিশু-বাচ্চা, সাধারণ মানুষ গণহত্যার বিচার করা হবে।’ সোহেল রানা নামে একজন প্রশ্ন করেছেন, ‘তুমি আজ কয় কলকে গাজা খাইছো?’ সুমন আহমেদ নামে একজন প্রশ্ন করেছেন, ‘দেশে আছনি? দেশো আইয়া প্রতিবাদ কর দেখি, তর কেমন সাহস!’ নুরুল আমিন নামে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘কত ছাত্র মারছো? তুমি ছাত্রদের মৃত্যু নিয়ে কোন কথা বলো নাই। তুমি নিজেরটা চিন্তা কর। মিথ্যা কথা বলায় তুমি অসম্ভব পারদর্শী। তুমি এত ভাল মানুষ, পালাইছো কেনো? দেশে আসো। বাংলাদেশে আস খেলা হবে।’ আরিফ উদ্দিন নামে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘ছাত্রদের খেছা খাইতায় নি, দূর হ পাঠা।’ কাজী ফায়জুল নামে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘ভাতিজা আপনি কোথায়? লন্ডনে পালিয়ে গিয়ে বড় বড় কথা বলে লাভ নেই। দেশে আসেন, খেলা হবে।’ সাহেদ আহমেদ নামে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘তুমি সিলেটর কলঙ্ক। দেশে আসো খুনি। তোমাকে আর তোমার নেত্রীকে ডিম থেরাপি দেয়া হবে।’আফজাল হোসাইন নামে একজন মন্তব্য করেছেন,‘বান্দির ফুয়া কিলা ফালাইলে বে।’ জামিল আহমেদ নামে একজন মন্তব্য করেছেন,‘কুত্তা তুই আবারো আইছতনি লাইব বকবক করতে।’ অভি চৌধুরী নামে একজন মন্তব্য করেছেন,‘এতো সুন্দর সুন্দর মন্তব্য গুলো কি ফালতু ছুদার চোখে পড়ে না?’ মোহাম্মদ নাইম নামে একজন মন্তব্য করেছেন,‘পাডার পাডা ৫ হাজার পুলিশ আর লক্ষ লক্ষ তর নেতাকর্মী কোথায় মারা গেলো, এতো মিথ্যা কথা কছ কেম্নে রে পাডা।’ রেজোয়ান আহমেদ নামে একজন মন্তব্য করেছেন,‘সালা বাংলা মাল খেয়ে কথা বলতাছে।’ নুরুল হোসাইন নামে একজন মন্তব্য করেছেন,‘গণহত্যার অন্যতম ফেরারি আসামী এই খুনিকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফিরিয়ে এনে ফাসি দিতে হবে।’এছাড়া অসংখ্য মানুষ তার কথা শোনে নিয়ে হাসি-তামাশা করেছেন। অসংখ্য মানুষ তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছেন।
এদিকে নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সিলেট মহানগর কমান্ড এর সদস্য বলেছেন, আনোয়ারুজ্জামানের বড় ভাই ও মামা ছিলেন রাজাকার। তিনি রাজাকার পরিবারের সন্তান।
উল্লেখ্য, পাঁচটি গুরুতর অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হয়েছিলেন আনোয়ারুজ্জামান। শেখ রেহানার প্রার্থী বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের কাছে পরিচিত যুক্তরাজ্য প্রবাসী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাঁচটি ছিলো:-
১। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসেবে তিনি যে হলফনামা জমা দিয়েছিলেন, তাতে যুক্তরাজ্যে থাকা তাঁর সম্পত্তির তথ্য উল্লেখ করেননি। অথচ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) বলা আছে, প্রার্থীর সম্পদের হিসাব হলফনামায় দেখাতে হবে। নির্বাচনী আইন ও বিধি অনুযায়ী প্রার্থীর দেশে–বিদেশে যেখানেই সম্পদ থাকুক, তা হলফনামায় দেখাতে হবে। কিন্তু তিনি এই আইন ভঙ্গ করে বিদেশে থাকা তাঁর সম্পদের তথ্য গোপন করেছিলেন।
২। আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী একজন দ্বৈত নাগরিক। যুক্তরাজ্যের সরকারি সংস্থা কোম্পানী হাউজের ওয়েবসাইটে ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে তাকে সাতটি কোম্পানীর ডিরেক্টর হিসেবে দেখানো হয়েছে। সবকয়টিতে তাঁর জাতীয়তা ব্রিটিশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের আগে মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী তাঁর ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন বলে কোন ঘোষণা দেননি এবং এই মর্মে কোন প্রমাণও পাওয়া যায়নি। কিন্তু গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) বা নির্বাচন বিধি অনুসারে কোন বিদেশি নাগরিক অথবা দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী ব্যাক্তি বাংলাদেশে নির্বাচনের অযোগ্য বলে ঘোষিত হবেন। সেক্ষেত্রে একটি নাগরিকত্ব (অর্থাৎ বিদেশী নাগরিকত্ব) তাকে মনোনয়নপত্র দাখিলের আগেই পরিত্যাগ করার কথা। অথচ তিনি তা করেননি।
৩। নির্বাচনী হলফনামায় আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতার স্থলে “বিএ (অনার্স) ব্যবসা” উল্লেখ করেছিলেন। অথচ এমন কোনো ডিগ্রি তাঁর নেই বলে জানা গেছে। একারণে এই সনদের সত্যায়িত অনুলিপি তিনি হলফনামায় সংযুক্ত করেননি। অথচ স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) বিধিমালা অনুসারে সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতার সত্যায়িত অনুলিপি হলফনামার সঙ্গে সংযুক্ত করার কথা।
৪। ভোটের আগের দিন মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামানের প্রার্থীতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে রিট করা হয়েছিলো। বলা হয়েছিলো, ‘আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী তাঁর হলফনামায় জন্মতারিখ ১৯৭০ সালের ১ জুন উল্লেখ করেছেন। অথচ তাঁর এসএসসি পরীক্ষার সনদপত্রে জন্মতারিখ ১৯৭২ সালের ১ জুন। এসএসসির সনদে উল্লেখিত জন্ম তারিখে ও হলফনামায় দেওয়া জন্মতারিখে গরমিল আছে। শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথে এসব দিক তুলে ধরে রিটটি করা হয়েছিলো।
৫। মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান ও তাঁর অনুগত কর্মীদের বিরুদ্ধে রাতের আধাঁরে নির্বাচনী দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রিসাইডিং অফিসারদের বাসায় গিয়ে নগদ অর্থ বিতরণের তথ্য পাওয়া গিয়েছিলো। প্রত্যেক প্রিসাইডিং অফিসারকে ১ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হয়েছিলো বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রিসাইডিং অফিসার নিজে ৫০,০০০ টাকা পেয়েছেন বলে গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন।
মেয়র হবার পরেও তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, মানি লন্ডারিং, টাকা ছাড়া কাজ না করা, প্রবাসীদের জমি-জামা ও বাড়ি-ঘর উদ্ধারের নামে টাকা নেয়া, সন্ত্রাসীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেয়া ইত্যাদি নানান অভিযোগ আছে। এসব সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সম্পর্কে গণমাধ্যমকে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী আজ পর্যন্ত কোনো জবাব দেননি। সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ দিয়ে জনগণের কাছে তিনি নিজের অবস্থান পরিস্কার করতে পারেননি। উপরন্তু নির্বাচনী মনোনয়নপত্রে সম্পদের তথ্য গোপন সম্পর্ক নির্বাচনের আগে দেশের শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি নির্বাচনী ব্যস্ততার কথা বলে এড়িয়ে যান এবং পরে যোগাযোগ করবেন বলে জানান। কিন্তু নির্বাচনের পরে তিনি আর প্রথম আলোর সাথে যোগাযোগ করেননি। বিলেতের কোন সংবাদ মাধ্যমেও তিনি এসব অনিয়মের বিষয়ে কোন রকম জবাবদিহি করেননি। অথচ দেশ থেকে পালিয়ে এসে এখন তিনি বড় বড় কথা বলছেন। দেশের মানুষের মত প্রবাসীরাও তাকে অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে বিচারের দাবি তুলেছেন। এছাড়া যারা তাকে পালিয়ে আসতে সাহায্য করেছেন, তাদেরকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনার, বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন।