সরকার ও নির্বাচন কমিশন যেকোনো মূল্যে ইভিএম কিনতে চায়। সাধারন মানুষ বলছে, এটা জালিয়াতির যন্ত্র, অর্থের অপচয়। বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, ইসি এই তুঘলকি কাণ্ড থেকে সরে আসবে।
ইভিএম কিনতে ৮৭১১ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৫০ আসনের জন্য ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কিনতে চায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। এসব আসনের জন্য ইভিএম কিনতে ৮ হাজার ৭১১ কোটি ৪৪ লাখ ২৩ হাজার টাকার প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। এর মধ্যে শুধু দুই লাখ সেট ইভিএম কিনতেই খরচ ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৬৬০ কোটি ২৯ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরেই এই অর্থের মধ্য থেকে ৩ হাজার ৬৬৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা চেয়েছে নির্বাচন কমিশন। এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রয়োজন হবে ২ হাজার ৯৯৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
বুধবার (১৯ অক্টোবর) ‘নির্বাচনি ব্যবস্থায় ইলেকট্রনিক্স ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহার বৃদ্ধি এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক এই প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এটা সরকারের একটি স্পর্শকারতর প্রকল্প। তাই প্রস্তাব পাওয়ার পর এখন ভালোভাবে পর্যালোচনা করে দেখা হবে। এর পর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হবে। সেখানেই দেখা হবে, ইভিএম কেনার দাম বেশি ধরা হয়েছে কি না। এক্ষেত্রে প্রতিটি ব্যয় পর্যালোচনা করেই সুপারিশ দেওয়া হবে।
প্রকল্প প্রস্তাবে নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, জাতীয় নির্বাচনে মোট ৪৫ হাজার ভোট কেন্দ্র স্থাপন করা হতে পারে। এর মধ্যে ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এসব আসনে আনুমানিক ভোটকেন্দ্র থাকবে প্রায় ২৫ হাজারটি। এগুলোর প্রতিটিতে সাতটি করে ভোট কক্ষে প্রায় ২ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ সেট ইভিএম প্রয়োজন হবে। এর সঙ্গে ভোটার শিখনের জন্য ৫০ হাজার সেট এবং প্রশিক্ষণে ব্যবহারের জন্য ২৫ হাজার সেট ইভিএম প্রয়োজন হবে। সর্বমোট ৩ লাখ ৩৮ হাজার সেট ইভিএম লাগবে। চলমান প্রকল্পের আওতায় কেনা ইভিএমের মধ্যে সচল রয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজারটি। এজন্য প্রস্তাাবিত প্রকল্পের আওতায় ২ লাখ ইভিএম কেনা হবে। এজন্য প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন থেকে আরও বলা হয়, স্বচ্ছ নির্বাচনি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় তথ্যপ্রযুক্তির টেকসই ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। সেজন্য আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব সংসদীয় আসনে এটি ব্যবহারের জন্য কাস্টমাইজেশন, সংরক্ষণ এবং অন্যান্য ব্যবস্থাপনা বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। সেইসঙ্গে স্থানীয় সরকারের সবপর্যায়ের নির্বাচনে ব্যবহার করা হবে এই ইভিএম।
প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ইভিএম সংক্রান্ত আগের একটি প্রকল্পের আওতায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের বেইজমেন্টে অস্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয়েছিল ইভিএম কাস্টমাইজেশন সেন্টার। এখন সেখানে নির্বাচন কমিশনের নকশা অনুযায়ী পার্সনালাইজেশন সেন্টার স্থাপনের কার্যক্রম চলছে। ফলে কম্পমাইজেশন সেন্টারটি দ্রুত অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। এজন্য এই ব্যয় বর্তমান প্রস্তাবিত প্রকল্পে ধরা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় ৫৪৩টি ডাবল কেবিল পিকআপ ভ্যান কেনা প্রয়োজন।
ইভিএম সংরক্ষণ: গুদাম তৈরিতে খরচ হবে ৩৭৩ কোটি টাকা
আগামী সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের লক্ষ্যে নেওয়া প্রকল্পে একেকটি ইভিএম কিনতে খরচ ধরা হয়েছে তিন লাখ পাঁচ হাজার টাকা করে। ইভিএম সংরক্ষণের জন্য ১০টি গুদাম (ওয়্যারহাউস) তৈরিতে খরচ হবে মোট ৩৭৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এ ছাড়া গুদাম তৈরির আগে প্রতিবছর গুদাম ভাড়া বাবদ খরচ ধরা হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা।
এরই মধ্যে প্রকল্প প্রস্তাব জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের জন্য গতকাল বুধবার পরিকল্পনা কমিশনে পৌঁছেছে।
‘নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহার বৃদ্ধি এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে আট হাজার ৭১১ কোটি ৪৪ লাখ ২৩ হাজার টাকা। প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হলে তা বাস্তবায়ন করা হবে চলতি বছরের নভেম্বর মাস থেকে ২০২৭ সালের অক্টোবর মেয়াদে। এটি বাস্তবায়ন করবে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। প্রকল্পটি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হবে দেশের টাকায়, অর্থাৎ প্রকল্পে কোনো বিদেশি ঋণ নেই। প্রকল্পের প্রস্তাব থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচন কমিশন মূলত তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে এই প্রকল্পের প্রস্তাব করেছে।
যেখানে সরকার অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে ব্যয় সংকোচনের কথা বলছে, সেখানে এমন প্রকল্প নেওয়া ক্ষমতার অপব্যবহার। তিনি নির্বাচন কমিশনের সংবেদনশীলতার অভাব আছে উল্লেখ করে বলেন, যেখানে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ইভিএমের বিরোধিতা করেছে, সেখানে এমন প্রকল্প নেওয়ার সিদ্ধান্ত কোনোভাবে প্রত্যাশিত নয়। তিনি আরো বলেন, যে দামে এই ইভিএম কেনা হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক মানের ইভিএমের চেয়ে বেশি। এই সময়ে বিশাল ব্যয়ে গুদাম নির্মাণ কতটা যৌক্তিক, তা-ও ভাবার বিষয়।
প্রকল্পের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, স্বচ্ছ নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং তথ্য-প্রযুক্তির টেকসই ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এ ছাড়া ১৫০ সংসদীয় আসনে ইভিএম ব্যবহার ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এটি ব্যবহারে অংশীজনের আস্থা অর্জন করা। ইভিএম ব্যবহারে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি করা। প্রকল্পের ফলাফলে বলা হয়েছে, নাগরিকদের গণতান্ত্রিক ভোটাধিকার নিশ্চিত এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বৃদ্ধিতে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা।
প্রকল্পের পটভূমিতে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। সে ক্ষেত্রে ১৫০ আসনে আনুমানিক ২৫ হাজার ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে। বর্তমানে চলমান প্রকল্পের আওতায় দেড় লাখ ইভিএমের মধ্যে মোট এক লাখ ৩৮ হাজার ইভিএম সচল আছে। নতুন ও পুরনো মিলিয়ে সাড়ে তিন লাখ ইভিএম সংরক্ষণ করতে হবে। সারা দেশের ৩০ জেলায় তা করতে গেলে প্রতিবছর গুদামভাড়া বাবদ ব্যয় হবে পাঁচ কোটি টাকা।
প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নির্বাচনের পরে এসব ইভিএম রাখতে সারা দেশে ১০টি গুদামের প্রতিটিতে খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ৩৭ কোটি টাকা করে, মোট ৩৭৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এ ভবনের জন্য জমি কেনাতেই খরচ ধরা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ইভিএম কাস্টমাইজেশন সেন্টার স্থাপন, আঞ্চলিক ওয়্যারহাউস নির্মাণ, ইভিএম পরিবহন ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত কাজেই মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে এক হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া ইভিএমকেন্দ্রিক প্রশিক্ষণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২০৫ কোটি টাকা। প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় ব্যয় হবে ৬৯০ কোটি টাকা। এতে আরো দেখা যায়, নির্বাচনের সময় সিসিটিভি ও নিরাপত্তাসামগ্রী ভাড়ায় চালানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৩১ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এ ব্যয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে সিসিটিভি ভাড়া, কানেকশন সেট ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতিতে। এতে ব্যয় হবে ৫১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া সিসিটিভি স্থাপন ও সাপোর্ট সার্ভিসের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এই সময়ে এ ধরনের প্রকল্প অপব্যয়। তা ছাড়া নির্বাচন স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে হওয়াই ভালো।
এর আগে গত ১৯ সেপ্টেম্বর ইসি সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ ইভিএম কেনার প্রকল্পের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, মোট দুই লাখ ইভিএম কেনা হবে। প্রকল্প প্রস্তাবে গুদাম নির্মাণ, গাড়ি, প্রশিক্ষণ—এসব খাতে ব্যয়ও প্রকল্প প্রস্তাবে যুক্ত করা হয়েছে।
ইভিএমের জন্য ৫৩৪ গাড়ি কিনবে ইসি
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেড়শ আসনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট আয়োজনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ জন্য নতুন করে দুই লাখ ইভিএম মেশিন ক্রয়ে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিটি ইভিএম ক্রয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা যা আগের দামের তুলনায় ১ লাখ টাকা বেশি। আগের দেড় লাখসহ মোট সাড়ে তিন লাখ ইভিএম মেশিন পরিবহনে ৫৩৮টি ডাবল পিকাপ গাড়ি ক্রয়ের প্রস্তাবও রাখা হয়েছে নতুন প্রকল্পে। প্রতিটি গাড়ির দাম ধরা হয়েছে ৪৯ লাখ টাকা। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
‘নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহার বৃদ্ধি এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক ৫ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য ইতোমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে ইসির পক্ষ থেকে। ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাবিত প্রকল্পে ইভিএমের জন্য পৃথক অনুবিভাগ করার কথাও বলা হয়েছে। ২ লাখ ইভিএম ক্রয়ের খরচ ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৬৬০ কোটি ২৯ লাখ টাকা। ইভিএম কাস্টমাইজ সেন্টার স্থাপন, অঞ্চলভিত্তিক ওয়ারহাউস নির্মাণ, ইভিএম সংরক্ষণ ও পরিবহনে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া ভোটার শিখন জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও দেশব্যাপী নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার বৃদ্ধি বাবদ ২০৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রকল্প ব্যবস্থাপনার খরচ ধরা হয়েছে ৬৯০ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত প্রকল্পের মেয়াদকাল চলতি বছরের নভেম্বর থেকে ২০২৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। ইভিএম মেশিন পরিবহনে ৫৩৮টি ডাবল পিকাপ ক্রয়ের পাশাপাশি ৯৪ লাখ টাকায় ১টি জিপ, প্রতিটি ৫৭ লাখ টাকা করে ৩টি জিপ ক্রয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব গাড়ি ক্রয়ে ডিপিএম (সরাসরি ক্রয়) পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণে দেশের ৬৪ জেলাকে ১০টি অঞ্চলে ভাগ করে ১০টি ওয়ারহাউস নির্মাণ করা হবে। এ জন্য প্রাক্কলিত নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৫০ কোটি টাকা। সফটওয়্যার ক্রয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ কোটি টাকা।
নতুন প্রকল্পে ইসির নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনিস্টিটউটের বেজমেন্টে ১ কোটি টাকা ব্যয়ে কাস্টমাইজেশন সেন্টার স্থাপন করার প্রস্তাবও করা হয়েছে। এ ছাড়া আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ১১৯৫ জন কর্মী নেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক রয়েছে। এর মধ্যেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। তাদের হাতে এখন দেড় লাখ ইভিএম রয়েছে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এগুলো কেনা হয় প্রায় চার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের মাধ্যমে। এসব ইভিএমের মাধ্যমে ৭০-৮০টি আসনে ভোটগ্রহণ সম্ভব। একই দিন ১৫০ আসনে ভোটের আয়োজনে প্রয়োজন প্রায় সাড়ে তিন লাখ ইভিএম।
ইভিএমের প্রচারে ২০৬ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারে ব্যাপক প্রচার চালানোর উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। ফেসবুক, ইউটিউব, গুগল, টিকটক, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইভিএমের পক্ষে প্রচার চালানো হবে। ইভিএমবিরোধীদের মোকাবিলায় জনপ্রিয় ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাজে লাগানো হবে। ‘নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এ প্রচার চালানো হবে। প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য গতকাল বুধবার পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
ইভিএম প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় নতুন করে ২ লাখ ইভিএম কেনা হবে। প্রতিটির একক দর ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। বর্তমানের নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হাতে ১ লাখ ৫০ হাজার ইভিএম রয়েছে।
নতুন ভোটার, নারী ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে ইভিএমে ভোটদানে উদ্বুদ্ধ করতে এবং গণমাধ্যমে প্রচারে আরও ১৩ কোটি টাকা খরচ হবে। অডিও–ভিডিও কনটেন্ট তৈরিতে তিন কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। গণপরিবহনের টিকিট কাউন্টারের পাশাপাশি চায়ের দোকান, সেলুন, সুপারশপ ও ওষুধের দোকানে ব্যানার–ফেস্টুন টাঙানো হবে। ব্যয় হবে ৫৫ লাখ টাকা।
আগামী নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএমে ভোট হবে বলে নির্বাচন কমিশন আগেই ঘোষণা দিয়েছে। তবে ইভিএম ব্যবহারে প্রবল আপত্তি জানিয়ে আসছে বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল।
প্রকল্পের নথি থেকে জানা যায়, ভোটার শিখন, ইভিএম নিয়ে জনসচেতনতা ও দেশব্যাপী ইভিএমের ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রচার চালাতে ২০৬ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্বাচন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ইভিএমে ভোট গ্রহণে দক্ষতা বাড়াতেও এ অর্থ ব্যয় করা হবে।
প্রকল্পের প্রচারসংক্রান্ত অংশের নথি ঘেঁটে দেখা যায়, প্রচারের অংশ হিসেবে নির্বাচনের ছয় মাস আগে থেকে ১৫০টি আসনে পাঁচ হাজার স্কুলে ফ্লোর গেম বিতরণ করা হবে। পাশাপাশি প্রতিটি স্কুলে একটি করে মোবাইল গেম দেওয়া হবে। এতে খরচ হবে দেড় কোটি টাকা। নির্বাচনের ৯০ দিন আগে থেকে জেলা, উপজেলা, গ্রাম, বাজার ও জনবহুল স্থানে আটটি ভ্যান দিয়ে ইভিএমের পক্ষে প্রচার চালানো হবে। এতে খরচ হবে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ইভিএমের নেতিবাচক কনটেন্টের (আধেয়) বিপরীতে ইতিবাচক কনটেন্ট বানাতে খরচ করা হবে আড়াই কোটি টাকা।
নতুন ভোটার, নারী ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে ইভিএমে ভোটদানে উদ্বুদ্ধ করতে এবং গণমাধ্যমে প্রচারে আরও ১৩ কোটি টাকা খরচ হবে। অডিও–ভিডিও কনটেন্ট তৈরিতে তিন কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। নির্বাচনের ছয় মাস আগে থেকে গণপরিবহনের টিকিট কাউন্টারের পাশাপাশি চায়ের দোকান, সেলুন, সুপারশপ ও ওষুধের দোকানে ব্যানার–ফেস্টুন টাঙানো হবে। এতে ব্যয় হবে ৫৫ লাখ টাকা।
প্রচারের অংশ হিসেবে দেশে পাঁচটি আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করা হবে। এতে বিদেশি বিশেষজ্ঞদেরও আনা হবে। এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে দেড় কোটি টাকা।
প্রকল্পের নথি বলছে, নির্বাচনে সিসিটিভি ক্যামেরা ও নিরাপত্তাসামগ্রীর ভাড়া বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ২৫ হাজার সিসিটিভি ক্যামেরা ভাড়া নেওয়া হবে, সংযোগ সেট করাসহ যার মোট খরচ ৫২ কোটি টাকা। সিসিটিভি স্থাপনে খরচ হবে আরও সাড়ে ৩৭ কোটি টাকা। সিসিটিভি ক্যামেরার জন্য আইএসপি সংযোগে ১০ কোটি ও কেব্ল সংযোগে ১১ কোটি টাকা খরচ হবে।
নথি থেকে জানা যায়, এ প্রকল্পের আওতায় আউটসোর্সিংয়ের জন্য ১ হাজার ১৩৫ জনবল নিয়োগ দেওয়া হবে, যাঁদের বেতন–ভাতা বাবদ ১৯৬ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। ইভিএম সংযোজন ও নির্বাচনকালীন পরিবহনের সঙ্গে এসব জনবল সম্পৃক্ত থাকবেন।
এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় ২৬৪ কোটি টাকার যানবাহন কেনা হবে। যানবাহন নিবন্ধন ও নবায়ন ফি বাবদ খরচ হবে আরও ১৬ কোটি টাকা। পেট্রল কিনতে খরচ হবে ৯১ কোটি টাকা। আলাদা করে প্রশিক্ষণে ব্যয় হবে ৫২ কোটি টাকা। ওয়্যারহাউস নির্মাণের লক্ষ্যে ভূমি অধিগ্রহণে ৪০ কোটি টাকা খরচ হবে। ১০টি ওয়্যারহাউস বানাতে খরচ হবে ৩৭০ কোটি টাকা। এসব ওয়্যারহাউসে ইভিএম সংরক্ষণ করা হবে।
এ ছাড়া কম্পিউটার সফটওয়্যারে ২২ কোটি, আসবাব ও ওয়্যারহাউসের র্যাক কেনায় ৫৬ কোটি টাকা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ও থার্মাল কন্ট্রোল কেনায় খরচ হবে ১১০ কোটি টাকা।
ইসি বলছে, প্রকল্পটি তৈরির আগে সমীক্ষা করা হয়নি। অথচ পরিকল্পনা কমিশনের নীতিমালায় স্পষ্ট করে বলা আছে, ৫০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে কোনো প্রকল্প গ্রহণ করার আগে অবশ্যই সমীক্ষা করতে হবে।
তবে ইসি বলছে, এ ধরনের প্রকল্প আগে নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া সময়স্বল্পতার কারণে সমীক্ষা করা যায়নি।
প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, শুধু ইভিএম কেনায় খরচ হবে ৬ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ইভিএম সেন্টার স্থাপন, অঞ্চলভিত্তিক ওয়্যারহাউস নির্মাণ, ইভিএম সংরক্ষণ ও পরিবহনে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় খরচ হবে ৬৯০ কোটি টাকা।
ইভিএম প্রকল্পের বিভিন্ন খাতের ব্যয় সম্পর্কে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সরকার প্রধান আগামী বছর দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন, খাদ্যসংকটের কথা বলছেন। অথচ এ সময়ে ইভিএমের পক্ষে প্রচারে অস্বাভাবিক ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অকল্পনীয়।
বদিউল আলম বলেন, ‘অতীতেও ইভিএম কেনাকাটায় বাণিজ্য হয়েছে। অনিয়ম হয়েছে। খরচের যে বহর দেখা যাচ্ছে, তাতে এবারও ইভিএম কেনাকাটায় বাণিজ্য হবে। নাগরিক সমাজ, বিরোধী দলসহ বিভিন্ন মহল থেকে বিরোধিতা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন যেকোনো মূল্যে ইভিএম কিনতে চায়। এটা জালিয়াতির যন্ত্র। আশা করব, ইসি এই তুঘলকি কাণ্ড থেকে সরে আসবে।’