আরাকান নিউজ ডেস্ক: মিয়ানমারে ভেঙে পড়েছে জান্তা। একেবারে পতনের দ্বারপ্রান্তে। দুপক্ষের সংঘর্ষে গত কয়েক মাসে সেনাবাহিনীর একের পর এক জওয়ান ও ঘাঁটি হারানোর লম্বা পরিসংখ্যানের জেরেই এ মন্তব্য করছেন বিশ্লেষকরা। খানিকটা ঘুরিয়ে হলেও প্রথম এই মন্তব্য করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট মিন্ট সয়ে। বলেন, গত ৯ নভেম্বর জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকে বেশ উৎকণ্ঠার সঙ্গেই এ হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখলের পর প্রথমবারের মতো বেহাল দশায় পড়েছে জান্তা। বিদ্রোহী গোষ্ঠীর তীব্র আক্রমণে প্রায় প্রতিদিনই হারাচ্ছে নিজেদের ঘাঁটি। মারমুখী আক্রমণে প্রাণ হারাচ্ছে সেনারা। টিকে থাকতে না পেরে শেষপর্যন্ত দল বেঁধে আত্মসমর্পণও করছে তারা। বড় বড় শহর চলে যাচ্ছে বিদ্রোহীদের মুঠোয়। এক কথায়- মিয়ানমারে চলমান সেনা শাসনবিরোধী আন্দোলনের নায়ক এই বিদ্রোহীরা সেনাবাহিনীর চেয়েও বেশি শক্তিশালী।
এক বছর আগে ঠিক এ কথাটিই বলেছিলেন দেশটির ছায়া সরকারের প্রেসিডেন্ট ডুয়া লাশি লা। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গঠিত পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) ও মিত্র সংগঠন ইআরও’র এক বছর পূর্তিতে তিনি বলেন, অর্ধেক মিয়ানমারই এখন বিদ্রোহীদের দখলে।
অভ্যুত্থানের পরদিন থেকেই মিয়ানমারের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে রাস্তায় নামে দেশটির লাখ লাখ মানুষ। শুরু হয় ভয়াবহ সংঘর্ষ। বেশ কিছু বেসামরিক নাগরিকরা হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। যোগ দেয় জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব বাহিনী ও পদচ্যুত নির্বাচিত নেতাদের নিয়ে দ্য পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) বাহিনী গঠিত হয়।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পিডিএফসহ অন্য গোষ্ঠীগুলো ব্যাপক সাফলতা অর্জন করেছে। ২৭ অক্টোবর, তিনটি জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), দ্য তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং দ্য আরাকান আর্মি (এএ) সমন্বিতভাবে শান রাজ্যে জান্তাদের বিরুদ্ধে হামলা চালায়। এর পর থেকেই তারা শক্তিশালী রূপ নিয়ে বেশ কিছু রাজ্যসহ সেনা চৌকি দখলে নেয়। সমন্বিত এ জোটকে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স বলা হয়। ১০ দিনের ব্যবধানে, থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স জানিয়েছে, তারা ১০০টিরও বেশি সামরিক ঘাঁটি দখল করেছে। বেশ কয়েকটি প্রধান মহাসড়ক এবং সীমান্ত ক্রসিংয়ের নিয়ন্ত্রণও দখলে নিয়েছে। এটি জান্তাকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন মার অং চলতি সপ্তাহে নিক্কেই এশিয়াকে বলেছেন, সেনাদের মনোবল ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। কারণ অনেকেই দলত্যাগ করছে। এমনকি বেশির ভাগ সামরিক ক্যাম্প আত্মসমর্পণ করতেও প্রস্তুত।
দেশটিতে এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফরেন রিলেশনস কাউন্সিলের জোশুয়া কুরলান্টজিক বলেছেন, ‘এখন স্বীকার করার সময় এসেছে যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দ্রুত শক্তি হারাচ্ছে। সামরিক বাহিনী বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে, যেমনটি অনেক দেশে ঘটেছে।’ এতে স্পস্টতই জান্তা নেতা জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের ওপর চাপ বাড়ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সোমবারও তিনি দেশটির জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে সংঘর্ষ বন্ধ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তাদের মতপার্থক্যগুলোকে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সুরাহা মিলছে না কিঝুতেই।
জান্তা উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত অপারেশন ১০২৭ চলবে বলে জানিয়েছেন মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির (এমএনডিএএ) মুখপাত্র লি জার ওয়েনও।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, জান্তার সঙ্গে আলোচনার দরকার নেই। কারণ তাদের সামরিক বাহিনী দুর্বল। এটি এতটাই নিঃশেষ হয়ে গেছে যে, ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের দখলকৃত এলাকা পুনরুদ্ধার করার জন্য প্রয়োজনীয় স্থল বাহিনীর অভাব রয়েছে।
প্রায় ৩ বছর ধরে চলা সেনাবিদ্রোহীদের সংঘর্ষে এ পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে দশ লাখেরও বেশি।