- কারাবন্দী হলে অসুস্থ স্ত্রীকে কে দেখবে?
- দশ সপ্তাহের ভুলের খেসারত সারাজীবন দিতে হবে?
বাংলাদেশ নিউজ ডেস্ক: বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করা নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনুসকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানরা পাশে বসিয়ে ফটোসেশনের জন্য চায়ের দাওয়াত দেন। বিশ্বখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁকে আমন্ত্রিত করে গর্বিত হয়। আর শেখ হাসিনা সরকার গত ১৫ বছরে তাকে একজন ‘জঘন্য লোক’ প্রমাণের সব রকম চেষ্টাই করেছে। গণভবন তো দূরে থাক দেশের সরকারি কোনো বিশ্বাবিদ্যালয়েও তাঁর ডাক পড়েনি ছাত্রদের ভবিষৎ নির্দেশনা দেবার।
উপরন্তু নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিজ হাতে তিল তিল করে গড়া গ্রামীণ ব্যাংক থেকে একরকম ‘গলাধাক্কা’ দিয়ে বের করে দিয়েও শেখ হাসিনা হিংসত্মাক মানসিকতা একটুও কমেনি! শুধু অপমান করেই তিনি ক্ষান্ত হননি; এখন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ছলে বলে দখল করে নিয়েছেন।
সম্প্রতি নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অভিযোগ করেছেন, গ্রামীণ ব্যাংক গ্রামীণ টেলিকমসহ তার আটটি প্রতিষ্ঠান জোরপূর্বক দখল করেছে। তিনি বলেন, “আমরা অনেক ধরনের দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাই, কিন্তু এমন বিপর্যয় আগে দেখিনি। হঠাৎ করে বাইরে থেকে কিছু লোক এসে আমাদের নিজেদের অফিস থেকে সরে যেতে বলে।” মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আমরা ভয়ংকর পরিস্থিতিতে আছি। … আমাদের আটটি প্রতিষ্ঠান জবরদখল হয়ে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বের হয়ে আমরা গ্রামীণ টেলিকম ভবনটি বানিয়েছি। সেখানে আমাদের কর্মীরা নিয়মিত অফিস করছে, কাজকর্ম করছে। “হঠাৎ, চার দিন আগে আমরা দেখি বহিরাগতরা আমাদের অফিস দখল করছে। আমরা তাদের কাছে বহিরাগত হয়ে গেলাম। তারা তাদের ইচ্ছানুযায়ী এটি চালানোর চেষ্টা করছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না এটা কীভাবে হলো।”
মুহাম্মদ ইউনূস জানান, বিষয়টি নিয়ে পুলিশের কাছে গিয়েও তিনি প্রতিকার পাননি। তিনি বলেন, “আমার ঘর জবরদখল হয়ে যাচ্ছে। আমরা পুলিশকে জানিয়েছিলাম, একটা জিডি করেছিলাম। জিডির কপি নিয়ে পুলিশ এসেছিল, কিন্তু কোনো সমাধান দেয়নি। আমরা অফিস করতে পারছি না।”কিছু লোক তাদের কার্যালয়ের সামনে ঝাড়ু নিয়ে মিছিল করেছে উল্লেখ করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এর পেছনের কারণ তিনি বুঝতে পারছেন না। “আমরা কী হঠাৎ করে এমন একটি অবস্থানে পৌঁছেছি যেখানে আমাদের ঝাড়ু প্রাপ্য? আমরা নিজেদের জায়গায় আছি। আমরা আর অন্য কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাই না।” মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠিত সকল প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর একই ভবনে। “এই ভবনে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ব্যবসার লাভ দিয়ে। এসব প্রতিষ্ঠানে গ্রামীণ ব্যাংকের হস্তক্ষেপের কোনো কর্তৃত্ব নেই। গ্রামীণ ব্যাংকের তহবিল দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটিই গড়ে ওঠেনি।”
গ্রামীণ টেলিকম ভবনে (১৩ তলা) মুহাম্মদ ইউনূসের ১৬টি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিটির চেয়ারম্যান তিনি। গ্রামীণ ব্যাংক যে আটটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সেগুলো হলো—গ্রামীণ কল্যাণ; গ্রামীণ টেলিকম; গ্রামীণ শক্তি; গ্রামীণ সামগ্রী; গ্রামীণ ফান্ড; গ্রামীণ মৎস্য ও পশুসম্পদ ফাউন্ডেশন; গ্রামীণ কৃষি ফাউন্ডেশন এবং গ্রামীণ উদ্যোগ। ১২ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়।
শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মনে করেন ২০০৭ সালে বাংলাদেশে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তার রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ ভুল ছিলো। বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস দাবি করেছেন, তখন সেনা সমর্থিত সরকারের অনুরোধের পরও তিনি সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেননি। পরবর্তীতে সবার অনুরোধে রাজনৈতিক দল খোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই উদ্যোগটি শুরুর পর দশ সপ্তাহের মধ্যেই তিনি সেখান থেকে সরে আসেন। অধ্যাপক ইউনূস প্রশ্ন রাখেন, ‘দশ সপ্তাহের সেই ঘটনার জন্য সারাজীবন আমাকে খেসারত দিতে হবে?’
তিনি জানান, তার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা রয়েছে। তাতে সাজা হয়েছে। জামিনে আছেন একটি মামলার সাজায়। এর প্রভাব তার ব্যক্তি জীবনেও পড়ছে বলে তিনি জানান। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ব্যক্তিগত জীবনে সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। আমার স্ত্রী একজন ডিমেনশিয়া রোগী। সে আমাকে ছাড়া কাউকেই চিনতে পারে না। তার দেখাশোনার দায়িত্ব সব আমার। এ অবস্থায় জেলে থাকতে হলে আমার স্ত্রীর কী অবস্থা দাঁড়াবে? গ্রামীণের এসব প্রতিষ্ঠান থেকে আমরা কোনও বেতন-ভাতা নেই না। অবৈতনিকভাবে কাজ করি। এসব প্রতিষ্ঠান করতে গিয়ে আমি গেলাম। আমার সংসার গেলো। আমার ছেলে মেয়ের ভবিষ্যত গেলো। আমাকে দেখলে লোকে ভয় পায়। আমি আসামি মানুষ।
সর্বশেষ খবর, সোমবার (৪ মার্চ) ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের সঙ্গে নৈশভোজে যোগ দিয়েছিলেন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই বৈঠক ও নৈশভোজের আয়োজন করেন পিটার হাস। বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির সহায়তাকারী ও বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান “অপরচুনিটি ইন্টারন্যাশনাল”—এর প্রধান চিফ টেকনোলজি অফিসার গ্রেগ নেলসনের সাথে প্রফেসর ড. ইউনূসের সাক্ষাৎ উপলক্ষে এ আয়োজন করেন তিনি।
বৈঠকে গ্রামীণ এবং অপরচুনিটি ইন্টারন্যাশনালের বিভিন্ন স্বাস্থ্য কর্মসূচি নিয়ে প্রতিষ্ঠান দুইটির মধ্যে সম্ভাব্য সহযোগিতা বিষয়ে আলোচনা হয়। ওই নৈশভোজ ও আলোচনায় আরো অংশ নেন অ্যামি হাস, লরি নেলসন এবং গ্রামীণ শিক্ষার এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান নূরজাহান বেগম।
মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজেদের অফিসিয়াল পেইজে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এ তথ্য নিশ্চিত করে লিখেছে- “ড. ইউনূস এবং মিসেস ইউনূসের আতিথেয়তা করতে পেরে সম্মানিতবোধ করছি। তাদের কাজ লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে আসার ক্ষমতা দিয়েছে। ড. ইউনূস এবং তার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাগুলোর অগ্রগতি যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এই মামলাগুলো বাংলাদেশের শ্রম আইনের অপব্যবহারের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে বলে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছি।”
উল্লেখ্য, নোবেল পুরষ্কার লাভ করার মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই রাজনৈতিক দল গঠন করা কার্যক্রম শুরু করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি সেনাবাহিনীর সমর্থনে এবং ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। এর কিছুদিন পর থেকেই অধ্যাপক ইউনূসের রাজনৈতিক দল গঠনের গুঞ্জন শুরু হয়। যদিও ফখরুদ্দিন আহমদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করার আগে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে অধ্যাপক ইউনূসকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। ওয়ান ইলেভেনের এগারো বছর পর, একটি লেখার প্রতিক্রিয়ায় ২০১৮ সালের জুন মাসে বিবৃতির মাধ্যমে অধ্যাপক ইউনুস কেয়ারটেকার সরকার প্রধান হওয়ার আকাঙ্খার কথা জোর গলায় অস্বীকার করেছিলেন।
গবেষক-লেখক মহিউদ্দীন আহমেদ একটি লেখায় দুজন সেনা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে লিখেছেন, মুহাম্মদ ইউনূস কেয়ারটেকার সরকার প্রধান হওয়ার প্রস্তাবে রাজী না হওয়ার প্রধান কারণ ছিল এই সরকারের স্বল্প মেয়াদ। সে লেখার প্রতিক্রিয়ায় অধ্যাপক ইউনূস বিবৃতির মাধ্যমে জানিয়েছিলেন, “সেনাবাহিনীর প্রস্তাবে আমি কেন রাজী হইনি এ বিষয়ে যে কারণ তারা উল্লেখ করেছেন তা একেবারেই কল্পনাপ্রসূত। একেবারে হদ্দ বোকা না-হলে একজন অরাজনৈতিক বেসামরিক ব্যক্তি সেনাবাহিনীর নিকট তাঁকে দীর্ঘমেয়াদের জন্য একটি সরকারের প্রধানের পদে রাখার এরকম আবদার করার কথা কখনো চিন্তা করতে পারবে না।” পরবর্তীতে তিনি সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন।
২০০৭ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক ইউনূস দেশের মানুষের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি দেন। সে চিঠিতে তিনি নিজের রাজনীতি সম্পর্কে পরামর্শ ও সহযোগিতা কামনা করেন। সে চিঠিতে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, নতুন রাজনীতি সৃষ্টির জন্য প্রচণ্ড উদ্যোগ নিতে হবে। এটি করতে না পারলে পুরনো রাজনীতি থেকে পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না।
অধ্যাপক ইউনূস যখন রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য নানা তৎপরতা ও বিবৃতি দিচ্ছেন তখন দেশে জরুরি অবস্থা চলছে। জরুরি অবস্থার আওতায় দেশে রাজনৈতিক তৎপরতা তখন নিষিদ্ধ। এনিয়ে অনেকে তখন নানা সমালোচনা করতে থাকেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ইউনূস সাংবাদিকদের বলেন, “আইনের ভেতরে দল করব। আইন ভাঙব না।”
১৮ই ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক ইউনূস চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরে বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, তার দলের সম্ভাব্য নাম ‘নাগরিক শক্তি’। এসময় তিনি বলেন, রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া থেকে তার সরে আসার সুযোগ নেই। “এখন এগিয়ে যেতে হবে, গ্রামে গ্রামে গঠিত হবে ড. ইউনূস সমর্থক গোষ্ঠী।” “এখনকার অবস্থায় রাজনীতি না করার আর কোন অবকাশ নেই”।
রাজনীতিতে আসার জন্য তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে যে খোলা চিঠি দিয়েছিলেন তার তিনমাসের মধ্যেই সে প্রক্রিয়া থেকে সরে আসেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ২০০৭ সালের ৩রা মে অধ্যাপক ইউনূস রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন। এজন্য তিনি জাতির উদ্দেশ্যে একটি চিঠি প্রকাশ করেন। সে চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, যাদেরকে সঙ্গে পেলে দল গঠন করে জনগণের সামনে সবল ও উজ্জ্বল বিকল্প রাখা সম্ভব হতো তাদের আমি পাচ্ছি না। আর যারা রাজনৈতিক দলে আছেন তারা দল ছেড়ে আসবেন না। “বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে এ পথে অগ্রসর না হওয়াই সঠিক হবে মনে করে এ প্রচেষ্টা থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি,” চিঠিতে উল্লেখ করেন অধ্যাপক ইউনূস।
অধ্যাপক ইউনূস যখন রাজনীতিতে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেন তখন সেটির কড়া সমালোচনা করেছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স লিখেছিল, যারা রাজনীতিতে নতুন আসে তারা ভয়ঙ্কর হয়। তাদের তৎপরতা সন্দেহ করার মতো। “তারা জাতির ভালো করার পরিবর্তে আরও বেশি খারাপ করে,” বলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল অধ্যাপক ইউনূসের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকাকে আব্দুল জলিল বলেন, “এতদিনে ওনার শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে।”