দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর হলো। কিন্তু যাদের হাত ধরে দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাদের স্বীকৃতির প্রক্রিয়া এখনো বিতর্কমুক্ত হয়নি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের বাঁকে বাঁকে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা না হলেও অনেকে সনদ নিয়েছেন। ভাতাও নিচ্ছেন অনেকে। এ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কিন্তু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা ও তাদের কবর চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। তাদেরই একজন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী মো. মুমিনুল হক।
মা-বাবা ও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রেখে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে যান সিপাহী মমিনুল হক। দেশমাতৃকার জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেন।জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী মুমিনুল হককে স্বীকৃতি দিয়েছেন, তার পরিবারকে চিঠিসহ ভাতাও দিয়েছেন। কিন্তু গেলো ৫০ বছরে তাকে স্বীকৃতি দেয়নি স্বাধীন বাংলাদেশ। বরং এ রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিরা বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃতিকেও অস্বীকার করছে। মাতৃগর্ভে রেখে যাওয়া মমিনুল হকের সন্তান এখন তার বাবার কবর ও স্বীকৃতির খোঁজে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঁদপুর জেলার কচুয়ার সাহারপাড় গ্রামের সন্তান সিপাহী মো. মমিনুল হক বিমানবাহিনীর চতুর্থ এমওডিসি (আইডি নাম্বার ৮৮০৭৯২৩) পিএএফে কর্মরত ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের আহ্বানে বিমানবাহিনী থেকে পালিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার সালদা নদীর পাড়ে সম্মুখযুদ্ধে পাক হানাদারের গুলিতে শহীদ হন মমিনুল হক। কল্যা পথর নামক জায়গায় তাকে দাফন করা হয়। তার কমান্ডার ছিলেন মেজর এ টি এম হায়দার।
যদিও এ খবর জানতেন না শহীদ মমিনুল হকের সন্তানসম্ভবা স্ত্রী ও বৃদ্ধা বাবা-মা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও তার ফেরার পথ চেয়েছিলেন তারা। এরই মধ্যে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মমিনুল হকের বাবা ওয়াহেদ আলীর কাছে একটি চিঠি পাঠান। যেটি ছিল তার ছেলের যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হওয়ার স্বীকৃতি বা শোকবার্তা। চিঠির সঙ্গে ছিল দুই হাজার টাকার একটি চেক। চাঁদপুর জেলা (মহকুমা) প্রশাসক আইয়ুব কাদেরীর কাছ থেকে শহীদ মুমিনুল হকের বাবা ওয়াহেদ আলী ওই চিঠি ও চেক (নং ডিই-এ ২৯১৫৭৬, তারিখ ০১-০৮-১৯৭২ ইং) গ্রহণ করেন।
এই চেক নেওয়ার জন্য চাঁদপুর জেলা প্রশাসক আইয়ুব কাদেরী স্বাক্ষরিত একটি চিঠিও মমিনুল হকের বাবা ওয়াহেদ আলীকে দেওয়া হয়। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে মমিনুলের স্ত্রীর পেনশনের জন্য দুই কপি ছবি চেয়ে রেকর্ড অফিস থেকে টেলিগ্রামে বার্তাও দেওয়া হয়।
এসব ছাড়াও রেকর্ড অফিসের অনেক প্রমাণাদি থাকলেও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রের তালিকায় নাম নেই মমিনুল হকের। মাতৃগর্ভে রেখে যাওয়া শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এমরান হোসেন পরিচয় খুঁজে পাচ্ছেন না।
এমরান হোসেন বলেন, ‘স্বাধীনতার পরে আমার জন্ম। আমি মাতৃগর্ভে থাকতেই বাবা যুদ্ধে যান এবং শহীদ হন। বাবার শাহাদতের খবরে দাদা পাগলের মতো হয়ে আত্মহত্যা করে (বাসের নিচে মাথা দিয়ে) মারা গেছেন। নানা সংকটে মায়ের কোলেই বেড়ে উঠেছি। বুঝ হওয়ার পর থেকে বাবার কবর খুঁজছি। শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কিন্তু কেউ পাত্তা দেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘অনেক সন্ধানের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় বাবার কবর (অজ্ঞাত) খুঁজে পেলেও জেলা প্রশাসকের অনুমোদন ছাড়া দাবি করতে পারছি না। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া স্বীকৃতিপত্র ও মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স কনস্ট্যাবিউলারির (এমওডিসি) পরিচয়পত্র নিয়ে বিভিন্ন বাহিনীর অফিসে গিয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আবেদন করেছি কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।’
কী কারণে কাজ হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটা সময় মন্ত্রণালয় বলছে বিমানবাহিনীর প্রত্যয়নপত্র লাগবে। বিমানবাহিনীর অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলছেন- আমাদের নথিতে আপনার বাবার বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। তখন কর্মকর্তাদের মুখের ওপর প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছি, তাহলে বঙ্গবন্ধুর এই চিঠি, বিমানবাহিনীর চিঠি ও আইডি কার্ড সবই কী ভুয়া? তারা জবাব দিতে পারেননি । বেশি কথা বললে রাগান্বিত হন। বেরিয়ে যেতে বলেন।’
‘সর্বশেষ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে আবেদন করেছি। তারা এমওডিসি রেকর্ডসের প্রতিবেদন চেয়েছে। অবশ্য এ বছরে (২০২১) এমওডিসি তাদের নথিতে বাবার সব তথ্য খুঁজে পেয়েছে এবং শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার বাবাকে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে প্রতিবেদন দিয়েছে।’
এমরান হোসেন বলেন, ‘আমি চাই শুধু বাবার কবর চিহ্নিত করে দিক, যাতে অন্তত জিয়ারত করতে পারি। আর বাবা যে দেশের জন্য জীবন দিলেন সেই স্বীকৃতিটা দিক।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন জানিয়েছে, তারা এরই মধ্যে এমরান হোসেনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিষয়টি তদন্তের জন্য ‘এমওডিসি সেন্টার অ্যান্ড রেকর্ডস’কে দিয়েছে। ‘এমওডিসি সেন্টার অ্যান্ড রেকর্ডস’ তাদের প্রতিবেদনে মমিনুল হককে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি মমিনুল হকের চাকরি ও যুদ্ধে যাওয়ার সব তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেছে। ওই সব তথ্য ও সুপারিশসহ মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে মমিনুল হককে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য চিঠি দেবে কমিশন। সূত্র: জাগো নিউজ