- অডিও রের্কড ও ‘পদত্যাগপত্র’ নিয়ে বিতর্ক
লণ্ডন, ১৭ সেপ্টেম্বর- তীব্র গণআন্দোলনের মুখে গত পাঁচ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তবে শেখ হাসিনা ভারতে কোন স্ট্যাটাসে রয়েছেন তা জানা নেই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের। শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনার সেখানে অবস্থানের বিষয়ে এখন পর্যন্ত দিল্লির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে জানতেও চায়নি ঢাকা।
মঙ্গলবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা কী স্ট্যাটাসে ভারতে রয়েছেন তা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে চায়নি বাংলাদেশ। এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, আমরা অফিশিয়ালি কিছু জানি না। তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেটুকু বলেছিলেন, ‘তিনি এসেছেন, খুব তাড়াতাড়ি তাকে…’। আমি অফিশিয়ালি কিছু তাদের বলিনি (শেখ হাসিনার স্ট্যাটাস নিয়ে)।
দেশ ছাড়ার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পাসপোর্টের মেয়াদ ৪৫ দিন পর শেষ হওয়ার কথা। পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিনি কোন প্রক্রিয়ায় সেখানে অবস্থান করবেন জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, সবকিছু শুধু আইন দিয়ে চলে না। ভারত সরকার তাকে আশ্রয় দিয়েছে, তিনি সেখানে থাকছেন; আমাদের এটা সেভাবেই দেখতে হবে।
অডিও রের্কড ও ‘পদত্যাগপত্র’ নিয়ে বিতর্ক
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেখ হাসিনার একটি ফোন রেকর্ড ফাঁসের ও কথিত ‘পদত্যাগপত্র’ ঘিরেই নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। দলীয় এক কর্মীর সাথে কথপোকথনের একটি অডিও কল রেকর্ডে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায় দেশ ছাড়ার আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন নি। ফাঁস হওয়া অডিওতে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, “আমি তো পদত্যাগ করি নাই। আমাদের সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যেভাবে পদত্যাগ করতে হয় আমার কিন্তু সেভাবে পদত্যাগ করা হয় নি”। তখন তিনি আরো বলেন, “বঙ্গভবনে গিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা আমি দেই নাই। কাজেই আমার পদত্যাগ হয় নি। আমি এখনো বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী”। ওই অডিও রেকর্ডে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায় তিনি যেকোনো সময় বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পারেন।
গত মাসে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরদিন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদও গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন তার মা পদত্যাগ করেন নি। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে মিছিল নিয়ে যেতে শুরু করে। সময় ছিল না। তিনি ব্যাগ গোছানোর সময়টুকুও পাননি। যতদূর জানি, সংবিধান অনুযায়ী তিনি এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।’ যদিও শেখ হাসিনা পতনের দিনই রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে জানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। ওই দিন রাতে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছিলেন, “আপনারা জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এবং আমি তা গ্রহণ করেছি”। গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পরই ওইদিন বিকেলে দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। এসময় তিনি বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও পদত্যাগ করেছেন। এখন একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে আমরা আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবো”।
শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ছয়ই অগাস্ট সেদেশের পার্লামেন্টে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি বলেছিলেন, ”আমাদের জানা মতে নিরাপত্তা বিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকের পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন।” পরবর্তীতে তিনি শেখ হাসিনা প্রসঙ্গে ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী’ বিশেষণ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন কী, করেন নি সেটি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ সেই নিয়েও নানা আলোচনা চলছে সবখানে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের মুখে কোন সরকার প্রধানই ঘোষণা দিয়ে পদত্যাগ করেন না। বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৭ ধারা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হওয়ার জন্য যে শর্তাবলী আছে সেগুলোর মধ্যে দুটি হলো রাষ্ট্রপতির নিকট পদত্যাগ জমা দেওয়া আর সংসদ সদস্য পদে না থাকা। গত ৫ই অগাস্ট রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণ অনুযায়ী, তিনি শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন এবং এর পরের দিন তিনি দ্বাদশ সংসদ ভেঙ্গে দিয়েছেন। এখন যদি তর্কের খাতিরেও ধরে নেই শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি, তবে এই বিষয়টি তো স্টেট নেসেসিটি থিউরিতে চলে গেছে। উনি তো কারো কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের অপেক্ষা করেন নি। তিনি তো দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এরপর রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়েছে। সংসদ ভাঙার পর ওনার তো প্রধানমন্ত্রীত্ব করার আর কোন সুযোগ থাকে না। গণঅভ্যুত্থান বা যুদ্ধ মুহূর্তে পদত্যাগের অর্থ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেলে ঘোষণা দিয়ে পদত্যাগ করা না। সংবিধানেও সেটা বলা নেই। নতুন একটা সরকার গঠনের এক মাস পরে এসে এই প্রশ্ন গুরুত্ব বহন করে না শেখ হাসিনা পদত্যাগ সঠিকভাবে হয়েছে কী না।