শিরোনাম
শুক্র. ডিসে ১২, ২০২৫

যেসব ভ্রান্তি এবং অপ্রাপ্তি নিয়ে এগিয়ে চলেছে বাংলা ভাষা

।। তারিক মনজুর ।।

বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের গৌরব যেমন আছে, তেমনি আছে কিছু অপ্রাপ্তির আফসোস। আছে ভাষাবিষয়ক কিছু ভ্রান্তি, দ্বিধা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে ভিত্তি করে যে আবেগ আমাদের ছিল, বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। ভাষা আন্দোলনের ৭৩ বছর পর সেসব নিয়েই মূল্যায়ন করেছেন তারিক মনজুর।

আমাদের রয়েছে ভাষার জন্য রক্তদানের ইতিহাস। এই ইতিহাস আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলা ভাষার গৌরব বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে বাংলা ভাষার রয়েছে বিস্তৃত, সমৃদ্ধ সাহিত্য। এই সাহিত্য হাজার বছরের বেশি পুরোনো। তবে বেদনাদায়ক হলেও সত্যি, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এত বছর পরেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আনা সম্ভব হয়নি। সম্ভব হয়নি বাংলা সাহিত্যের বিপুল অংশকে অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে পৌঁছানো। এগুলো ছাড়াও আরও অনেক ধরনের অপ্রাপ্তির আফসোস আছে। একই সঙ্গে আছে ভাষাবিষয়ক কিছু ভ্রান্তি। এসব ভ্রান্তি আমাদের ভাষাজ্ঞানের অপূর্ণতার পরিচয় দেয়। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেও যথাযথ নয়।

বানানের ভুল-শুদ্ধ

কোনো কোনো ক্ষেত্রে শব্দের লিখিত রূপের একাধিক বানান দেখা যায়। এর মধ্যে একটিকে ‘শুদ্ধ’ আর অন্যগুলোকে ‘ভুল’ বলার একটি প্রবণতা আছে। অথচ, বানানের নীতি কিংবা রূপান্তরের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে কোনোভাবেই এমনটি বলা যায় না। যেমন, ‘গোরু’ বানানে ও-কার দেওয়ার মানে এই নয় ও-কার ছাড়া বানানটি ভুল। আবার ‘ষ্টেশন’, ‘ঠাণ্ডা’ ইত্যাদি বানানে মূর্ধন্য-ণ বা মূর্ধন্য-ষ ব্যবহারের মানে এই নয় তা ভুল বানানে লেখা হচ্ছে। বরং একসময় সেই রকম বানানেই লেখা হতো। এখন এ রকম অনেক শব্দেরই বানান পরিবর্তিত হয়ে গেছে। বানানের প্রচলিত রূপকে বদলে ফেলার কারণে এসব সংকট তৈরি হয়। সুতরাং বানানের ক্ষেত্রে ভুল বা শুদ্ধ না বলে বরং বলা উচিত, বর্তমানে ‘প্রচলিত’ বা ‘অপ্রচলিত’ বানান। আরও ভালো হয় বানানের সর্বশেষ গৃহীত রূপটিকে ‘প্রমিত’ বলা হলে।

তৎসম-অতৎসম শব্দ

ব্যাকরণ বইয়ে আছে, যেসব শব্দ সংস্কৃত থেকে সরাসরি বাংলা ভাষায় এসেছে তাদেরকে তৎসম শব্দ বলে। অথচ এই ধারণার বদল ঘটে গেছে প্রায় শত বছর আগেই। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যুক্তি ও উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, বাংলা শব্দ সংস্কৃত থেকে আসেনি। তাঁর মতে, বাংলা শব্দ এসেছে প্রাকৃত বা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা থেকে। এমনকি জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন, যিনি ভারতীয় উপভাষা নিয়ে বিস্তৃতভাবে কাজ করেছেন, তিনিও মনে করেন বাংলা ভাষার জন্ম প্রাকৃত ভাষা থেকে। অথচ প্রচলিত ব্যাকরণ বইগুলো এখনো তৎসম-তদ্ভব শব্দের পরিচয় দিতে গিয়ে সংস্কৃত থেকে আগমনের সূত্র টেনে চলেছে!

উপভাষা ও আঞ্চলিক ভাষা

আমাদের স্কুলপাঠ্যে উপভাষা বলতে অঞ্চলবিশেষের ভাষাকে বোঝানো হয়ে থাকে। সাধারণ মানুষও মনে করে থাকেন, উপভাষা আর আঞ্চলিক ভাষা একই। অথচ উপভাষা শুধু আঞ্চলিক ভাষাবৈচিত্র্য নয়, এটি একই সঙ্গে সমাজের মানুষের ধর্ম, শ্রেণি, পেশা, বয়স, লিঙ্গসহ সব ধরনের ভাষাবৈচিত্র্যকে নির্দেশ করে। সূক্ষ্মতর অর্থে বলা যায়, প্রত্যেক মানুষই এক একটি উপভাষা বহন করে। সুতরাং আঞ্চলিক ভাষা প্রকৃতপক্ষে উপভাষার বহু রকমফেরের একটি। তা ছাড়া একটি আঞ্চলিক ভাষারও একাধিক রূপভেদ থাকতে পারে এবং তার মধ্যে একটি রূপকে প্রামাণ্য হিসেবে ধরা হয়। আর ভাষা কতটুকু আলাদা হলে তাকে উপভাষা কিংবা ভিন্ন ভাষা বলা যাবে, এরও কোনো সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। এর সঙ্গে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কও জড়িত।

ভাষার প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ

ভাষার অনেক প্রয়োগই প্রচলিত ব্যাকরণ সমর্থন করে না। সাধারণ বিবেচনায় সেগুলোকে ‘অপপ্রয়োগ’ বলা হয়। কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষার কোনো রূপকেই অপপ্রয়োগ বা প্রয়োগ-অশুদ্ধ বলা যায় না। বহুল ব্যবহারের কারণে বরং এসব প্রয়োগকেই ভাষার ব্যাকরণে নতুন করে সূত্রবদ্ধ করার প্রয়োজন পড়ে। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে আমাদের চাকরির পরীক্ষাগুলোতে ভাষার অপপ্রয়োগের নামে কিছু প্রশ্ন প্রায় নিয়মিতভাবেই দেখা যায়। প্রশ্নের এসব নমুনাও এতই গতানুগতিক যে সেই জ্ঞান ভাষার প্রায়োগিক ক্ষেত্রে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখে না।

প্রমিত উচ্চারণ

ভাষার লিখিত একটি রূপের মতো উচ্চারিত একটি রূপকে প্রামাণ্য বা প্রমিত ধরা হয়। আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে প্রমিত উচ্চারণে কথা বলার বা বক্তৃতা করার দরকার হয়। অভিযোগ আছে, বাংলা শিক্ষকেরাও শ্রেণিকক্ষে প্রমিত উচ্চারণে কথা বলেন না। অথচ স্কুল পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের এ ধরনের অনুশীলন করানো দরকার। এটা শিশু পর্যায়ে করা সম্ভব না হলে পরবর্তী সময়ে প্রমিত উচ্চারণে কথা বলার জন্য তাকে রীতিমতো পরিশ্রম করতে হয়। দুঃখজনক ব্যাপার, একদিকে আমরা প্রমিত উচ্চারণে কথা বলতে না পারার অভিযোগ করছি, অন্যদিকে এর প্রতিফলন দেখার জন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিইনি। এ বিষয়ে পাঠ্যবইয়েও কোনো দিকনির্দেশনা নেই।

ভাষা সম্পাদনা

কিছু ব্যক্তি বানান সংশোধনের কাজ করে থাকেন। তাঁদের প্রুফরিডার বলা হয়। তাঁদের কাজ মূলত বানান ঠিক করা। এ ধরনের ভুল এড়ানোর জন্য প্রাথমিকভাবে অভিধান দেখে নেওয়াই সবচেয়ে ভালো সমাধান। ভাষার প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটানো গেলেও বানান ভুল কমবে। দেশে প্রুফরিডারের অভাব নেই, তবে ভাষা সম্পাদনায় দক্ষ লোকের মারাত্মক অভাব রয়েছে। এ ধরনের ব্যক্তি তৈরি করা সম্ভব হলে তাঁরা যেমন বইয়ের ভাষা সম্পাদনার কাজ করতে পারতেন, তেমনি বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের ভাষাও দেখে দিতে পারতেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেও কেউ ভাষা সম্পাদনার মতো জরুরি কাজ করার দক্ষতা অর্জন করেন না।

ভাষা মিশ্রণ

বাংলা ভাষায় প্রতিনিয়ত অন্য ভাষার শব্দ এসে মিশছে। অনেকেই এই ভাষা-মিশ্রণকে অনাকাঙ্ক্ষিত মনে করেন। এমনকি এ-ও বলা হয়ে থাকে, শিশুরা ইংরেজি-হিন্দি মিলিয়ে নানা ভাষার কার্টুন, চলচ্চিত্র বা সিরিজ দেখার ফলে ঠিকমতো বাংলাও শিখছে না! প্রকৃতপক্ষে চলমান ভাষা হিসেবে অন্য প্রধান ভাষাগুলোর মতো বাংলাতেও অন্য ভাষার শব্দ ঢুকবে, এটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া বর্তমান বিশ্বের শিশুরা বহুভাষিক পরিস্থিতির সঙ্গে বড় হচ্ছে এবং পারস্পরিক যোগাযোগে সহজেই একাধিক ভাষার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে।

সর্বস্তরে বাংলা

আমাদের আসল সমস্যা এখানেই। আমরা আশা করেছিলাম, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়বে। দিন দিন বরং বাংলার ব্যবহার সংকুচিত হয়ে আসছে। রাস্তার সাইনবোর্ড, ব্যাংকের চেক, চাকরির আবেদন কিংবা জীবন-বৃত্তান্ত থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের যোগাযোগে বাংলার চেয়ে ইংরেজি ভাষাই বেশি ব্যবহার হচ্ছে। একটি সফল ভাষা আন্দোলনের পর আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, উচ্চশিক্ষায়, আদালতে এবং প্রশাসনিক কাজে বাংলা হবে প্রধান মাধ্যম। কিন্তু নিজেদের স্বপ্ন-বৃক্ষে নিজেরাই কুঠার দিয়ে আঘাত করে চলেছি। ওই বৃক্ষের শাখা-প্রশাখাগুলোও ঠিকমতো মেলতে দিইনি।

কোনো ভাষার ব্যবহারের মধ্য দিয়েই সেই ভাষার শক্তি ও সামর্থ্য বোঝা যায়। পৃথিবীর বহু ভাষা ঔপনিবেশিক আধিপত্যের ফলে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু প্রায় দুই শ বছরের ব্রিটিশ উপনিবেশের পরেও অন্য কোনো ভাষা বাংলা ভাষার জায়গা নিতে পারেনি। মুখের ভাষা, লেখার ভাষা হিসেবে বাংলা সগৌরবে টিকে রয়েছে হাজার বছরের বেশি সময় ধরে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিধিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার যত বাড়বে, নিঃসন্দেহে এ ভাষার শক্তি ও সামর্থ্যও তত বাড়বে।

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।

সম্পর্কিত পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *