ঢাকা, ১২ সেপ্টেম্বর- রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ছয়টি কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বিষয়টি জানান।
ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা যেহেতু জনগণের ভোটাধিকার ও মালিকানায় বিশ্বাস করি, সেহেতু নির্বাচন ব্যবস্থার উন্নয়নে আমাদের সংস্কার ভাবনায় গুরুত্ব পেয়েছে। আমরা মনে করি নির্বাচনের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠতার একাধিপত্য ও দুঃশাসন মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বা এর মাধ্যমে এক ব্যক্তি বা পরিবার বা কোনো গোষ্ঠীর কাছে সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব আশঙ্কা রোধকল্পে নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের কথা আমরা ভাবছি। নির্বাচন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রশাসন, বিচার প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন এই চারটি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য।
এসব প্রতিষ্ঠানের সংস্কার জনমালিকানা ভিত্তিক, জবাবদিহিমূলক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায়ও অবদান রাখবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এর পাশাপাশি সমাজের সর্র্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব ও স্বার্থ নিশ্চিত করার লক্ষে এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বার্তাকে প্রতিফলিত করার জন্য সাংবিধানিক সংস্কারের প্রয়োজন আমরা অনুভব করছি।
এসব বিষয়ে সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আমরা প্রাথমিকভাবে ছয়টি কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এসব কমিশনের কাজ পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককে এই কমিশনগুলো পরিচালিনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এরপর আরও বিভিন্ন বিষয়ে কমিশন গঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হবে বলেও জানান তিনি।
ড. ইউনূস আরো জানান, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করবেন সফর রাজ হোসেন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে ড. শাহদীন মালিক দায়িত্ব পালন করবেন।
ড. ইউনূস বলেন, এসব কমিশনের অন্য সদস্যদের নাম কমিশন প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হবে। কমিশনগুলোর আলোচনা ও পরামর্শ সভায় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ছাত্র, শ্রমিক, জনতা, আন্দোলনের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন।
সরকার প্রধান আরো বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হওয়ার পর কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কাজ আগামী ১ অক্টোবর থেকে শুরু করতে পারবে বলে আশা করছি এবং এটি পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আমরা ধারণা করছি। কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ সভার আয়োজন করবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে ছাত্র সমাজ, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিনিধি নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক তিন থেকে সাত দিনব্যাপী একটি পরামর্শসভার ভিত্তিতে সংস্কার ভাবনার রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। এতে এই রূপরেখা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তার একটি ধারণাও দেওয়া হবে। এই আয়োজন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বার্তা বাস্তবায়ন এবং রাষ্ট্র পুনর্নিমাণ তাগিদের ঐক্যবন্ধনে গোটা জাতিকে শক্তিশালী ও আশাবাদী করে তুলবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, আমরা সংস্কার চাই। আমাদের একান্ত অনুরোধ, আপনাদের ওপর যে সংস্কারের গুরু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেই দায়িত্ব নিয়ে আপনারা দর্শকের গ্যালারিতে চলে যাবেন না। আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকবেন। আমরা একসঙ্গে সংস্কার করব। এটা আমাদের সবার দায়িত্ব।
তিনি সবাইকে সংস্কারকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এই সংস্কারের মাধ্যমে আমরা জাতি হিসেবে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করতে চাই। আমাদের এই যাত্রা আমাদের পৃথিবীর একটি সম্মানিত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করুক এটাই আমাদের সবার কাম্য।’
প্রধান উপদেষ্টা বিগত মাসে বেশ কিছু রাজনৈতিক দল, দেশের বিশিষ্ট সম্পাদকগণ ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক ও মতবিনিময় করার কথা উল্লেখ করে বলেন, তারা সংস্কারের কাজে পূর্ণ সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তারা বিভিন্ন বিষয়ে মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন এবং ছাত্র, শ্রমিক ও জনতা বিপ্লবের লক্ষ্যের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মুখে এবং হাজারো মানুষের আত্মদানের বিনিময়ে বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হয়েছে। এই গণঅভ্যুত্থানের বার্তা ও আকাক্সকা বাস্তবায়নের জন্য একটি অভূতপূর্ব সময় ও সুযোগ আমরা এর মধ্যে দিয়ে অর্জন করেছি। এর বাস্তবায়ন তথা বাংলাদেশে ফ্যাসিজম বা স্বৈরতান্ত্রিক শাসন পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা রোধ এবং জনমালিকানা ভিত্তিক, কল্যাণমুখী ও জনস্বার্থে নিবেদিত একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে কিছু জাতীয় ভিত্তিক সংস্কার সম্পন্ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ওই সংস্কার ভাবনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।’
সামনে অনেক কাজ উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘সবাই মিলে একই লক্ষ্যে আমরা অগ্রসর হতে চাই। আমাদের মধ্যে, বিশেষ করে আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে যে সুপ্ত প্রতিভা লুকিয়ে আছে, সেটা যেন বিনা বাধায় রাষ্ট্রের ও সমাজের সহযোগিতায় প্রকাশ করতে পারি। সেই সুযোগের কাঠামো তৈরি করতে চাই। সকলে মিলে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করতে চাই। এই হলো আমাদের সংস্কারের মূল লক্ষ্য।
ছাত্র, শ্রমিক, জনতার এই বিপ্লবের লক্ষ্যকে দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের প্রথম মাসে আমরা যে গতিতে, যে উদ্যম নিয়ে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করেছিলাম, হয়তো সেটা করতে পারিনি বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা গেলে আশা করি আমরা আমাদের গতি অনেক বাড়াতে পারব। এজন্য দেশের সকল মানুষের কাছে সহযোগিতা চান তিনি।
ড.ইউনূস বলেন, আমাদের কাজ বড় কঠিন, কিন্তু জাতি হিসেবে এবার ব্যর্থ হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। আমাদের সফল হতেই হবে। এই সাফল্য আপনাদের কারণেই আসবে। আপনাদের সহযোগিতার কারণে আসবে। আমাদের কাজ হবে আপনার, আমার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করা। ‘তিনি বলেন, এখন আমরা দ্বিতীয় মাস শুরু করছি। আমাদের দ্বিতীয় মাসে যেন আপনাদের মনে দৃঢ় আস্থার সৃষ্টি করতে পারি সে চেষ্টা করে যাব।’