- শীর্ষ নেতাদের হত্যা করাই ছিল টার্গেট।
- স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি।
মিনহাজুল আলম মামুন, ১৭ জুলাই- জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সারাদেশে পদযাত্রা ও পথসভা করছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জের পদযাত্রাটি ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ শিরোনামে ঘোষিত হয়। উত্তরের প্রায় সবগুলো জেলায় শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা কর্মসূচি শেষে গোপালগঞ্জে এনসিপির প্রোগ্রামে ভয়ঙ্কর হামলা চালায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা। এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা সভামঞ্চে পৌঁছার আগেই সকাল থেকে গোপালগঞ্জের চৌরঙ্গি মোড়ে এনসিপির সভামঞ্চ একাধিকবার হামলার শিকার হয়। নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে হাসনাত আব্দুল্লাহ, সার্জিস আলম, আখতার হোসেনসহ কেন্দ্রীয় নেতারা গোপালগঞ্জে আসার পথে বিভিন্ন স্থানে বাধা ও আক্রমণের শিকার হওয়া সত্ত্বেও দুপুর ২টা নাগাদ সভামঞ্চে পৌঁছে সভা শেষ করে ফেরার পথে শত শত সশস্ত্র ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীর আক্রমণের শিকার হন। দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র, ইটপাটকেল, মুহুর্মুহু ককটেল বিস্ফোরণ, আগ্নেয়াস্ত্রের মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হিমশিম খেতে হয়। পুলিশ-বিজিবির পাশাপাশি সেনাবাহিনীর অ্যাকশনে সত্ত্বেও রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়া গোপালগঞ্জ শহর থেকে এনসিপি নেতাদের নিরাপদে সরিয়ে আনতে সেনাবাহিনীর এপিসি ব্যবহার করা হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে অন্তত চারজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এনসিপি ও সন্ত্রাসী গ্রুপের বেশ কিছু লোক আহত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে স্থানীয় প্রশাসন গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করেছে।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে ধ্বংস করেছে হাসিনা। দলটিকে চিরতরে নিঃশেষ করতে উঠে পড়ে লেগেছে সেই খুনি হাসিনা। পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শীর্ষ নেতাদের ওপর দফায় দফায় হামলা হয়েছে। মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী দুই দিন আগে আশপাশের এলাকা থেকে গোপালগঞ্জ শহরে হাজার হাজার নেতাকর্মী জড়ো করে আওয়ামী লীগ। টার্গেট ছিল এনসিপিকে ঢুকতে দেওয়া হলেও তাদের জীবিত বের হতে দেওয়া হবে না। বিশেষ করে শীর্ষ নেতাদের হত্যা করা মিশন সফল করতে স্বয়ং শেখ হাসিনা ইন্ডিয়া থেকে মোবাইল ফোনে গোপালগঞ্জে একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলেন। এনসিপির বিরুদ্ধে জনগণকে উসকে দিতে বেশকিছু অডিও বার্তাও পাঠান। এছাড়া পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক সিনিয়র নেতা সমন্বয় করেন। এমনকি ইন্ডিয়ায় পলাতক ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ছিলেন আরও এক ধাপ এগিয়ে। ফেসবুক লাইভে এসে তিনি সরাসরি হামলা চালানোর নির্দেশনা দেন।
সুরমা অফিসে আসা এমন একটি অডিও বার্তায় শোনা যায়, শেখ হাসিনা নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালকে বলেন, ‘ওরা (এনসিপি) নাকি গোপালগঞ্জে যাচ্ছে। টুঙ্গিপাড়ায় আমার বাবার কবর ভেঙে ফেলার ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে ৩২ নম্বরের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এবার টুঙ্গিপাড়ায় হামলা চালাবে। তোমরা বসে আছ কেন? যে যেভাবে পার প্রতিহত কর। গোপালগঞ্জে কোনোভাবেই যাতে ওরা ঢুকতে না পারে। কোনো ধরনের কর্মসূচি যাতে করতে না পারে। মনে রাখবা, গোপালগঞ্জের মাটি থেকে ওদের কেউ যাতে অক্ষত অবস্থায় ফিরে যেতে না পারে।’
আরেকটি অডিও বার্তায় শেখ হাসিনা নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও শহরের বেদ গ্রামের বাসিন্দা নিউটন মোল্লাকে বলেন, ‘তোমরা ওখানে (গোপালগঞ্জে) বসে কী কর। ওরা (এনসিপি) বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন জড়ো করার চেষ্টা করছে। পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা ও ফরিদপুরসহ আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে লোকজন একত্রিত করে গোপালগঞ্জে ঢুকবে। এরপর টুঙ্গিপাড়ায় যাবে। যেভাবে পার ওদের প্রতিহত করতে হবে। টুঙ্গিপাড়ায় যাতে কোনোভাবেই ওরা ঢুকতে না পারে। আর যদি টুঙ্গিপাড়ায় ঢুকেই পড়ে, তাহলে একজনও যাতে জীবিত অবস্থায় ওখান থেকে ফিরে যেতে না পারে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পরদিন বুধবার গোপালগঞ্জ পৌর পার্ক মাঠে এনসিপির কর্মসূচির দিন সকালে নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালের নেতৃত্বেই স্থানীয় চর দুর্গাপুর এলাকায় পুলিশের গাড়িতে হামলা, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে এনসিপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার বিষয়টি এলাকায় জানান দেয় আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। শহরের মোহাম্মদপাড়ার বাসিন্দা এই আতাউর রহমান পিয়ালের নেতৃত্বেই পরে এনসিপি নেতাদের গাড়িবহরে কয়েক দফা গুলি ও বোমা হামলা চালানো হয়।
একইভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিউটন মোল্লার নেতৃত্বে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং জেলা কারাগারে হামলা চালানো হয়। স্থানীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, নিউটন মোল্লার প্রধান টার্গেট ছিল কারাগারের প্রধান ফটক ভেঙে সেখানে আটক থাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিএম শাহাবুদ্দিন আজমসহ দলের নেতাকর্মীদের বের করে আনা। যদিও পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর শক্ত অবস্থানের কারণে তার এ অপচেষ্টা সফল হয়নি। এছাড়া গোপালগঞ্জ জেলা যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাসুদ রানার নেতৃত্বে ওইদিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়িতে হামলা চালানো হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেবল নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগই নয়, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগসহ দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে একাধিকবার টেলিফোনে কথা বলেন। গোপালগঞ্জের মাটিতে এনসিপি যাতে কোনোভাবেই তাদের কর্মসূচি পালন করতে না পারে, সেজন্য প্রত্যেককে তিনি নির্দেশনা দেন। শেখ হাসিনার নির্দেশের পর এনসিপির কর্মসূচি পণ্ড করাসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের হত্যা করতে গোপালগঞ্জে থাকা দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা চতুর্দিক থেকে একযোগে হামলা চালান। এ সময় নেতাকর্মীদের সমন্বয় করেন কলকাতায় থাকা শেখ হাসিনার ফুপাতভাই গোপালগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, লন্ডনে বসে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য আব্দুর রহমান, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও শরীয়তপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য ইকবাল হোসেন অপু এবং গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহবুব আলী খান ও সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল আলম কাজল।
তাদের বাইরে গোপালগঞ্জসহ আশপাশের জেলা-উপজেলায় আত্মগোপনে থাকা নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংগঠিত করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। কলকাতায় আত্মগোপনে থেকেই ফেসবুকে লাইভে এসে তিনি মাঠের কর্মীদের এনসিপির কর্মসূচিতে হামলা করতে নির্দেশনা দেন। স্থানীয় পর্যায়ে নারীদের এ কাজে সংগঠিত করেন কলকাতায় আত্মগোপনে থাকা গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল আলম কাজলের স্ত্রী ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী ইয়াসমিন আলম। বিষয়টি জানার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুলিশ তাকে আটক করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পৌর পার্কের পাশেই ঐতিহাসিক কোর্ট মসজিদ থেকে উসকানিমূলক ঘোষণা দিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দফায় দফায় মাইকে ঘোষণা দিলে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে আসে। ওই সময় মাইকে এও বলা হয়, ‘পুলিশ এবং সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি করছে। এতে অনেক লোকজন নিহত হয়েছেন।’ এ ধরনের প্রচারণায় সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। এর আগে হামলা চালাতে ঘোষের চর, চর মানিকদহ, ডুমদিয়া, হরিদাসপুর, উলিপুর, পাইককান্দি, গোনাপাড়া, ফকিরকান্দি, বেদগ্রাম, সোনাকুর, গোবরা, রঘুনাথপুরসহ আশপাশের গ্রাম থেকে বিপুলসংখ্যক লোকজন শহরের পৌর পার্ক এলাকায় জড়ো করা হয়। মার্চ টু গোপালগঞ্জ কর্মসূচি পালন করতে দুপুরের মধ্যেই এনসিপির নেতাকর্মীরা গাড়ির বহর নিয়ে শহরের পৌরপার্ক এলাকায় প্রবেশ করে। ঢাকা-মাওয়া-টেকেরহাট হয়ে ফরিদপুর-বরিশাল হাইওয়ে দিয়ে জালির পার, বানিয়ার চর, ভেন্নাবাড়ি, সাতপাড়া, বৌলতলী, করপাড়া, বাংসুর, উলিপুর, ভেড়ার বাজার, পুলিশ লাইন হয়ে দুপুর পৌনে ২টার দিকে শহরে ঢোকেন তারা। এর কিছুক্ষণ আগেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এনসিপির মঞ্চ ভাঙচুর করে। ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে এবং আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। সমাবেশস্থলে লাঠিসোঁটা নিয়ে অতর্কিত হামলা চালানো হয়। জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে হামলাকারীরা মঞ্চে থাকা সাউন্ড বক্স, মাইক এবং চেয়ার ভাঙচুর করে। উপস্থিত এনসিপি নেতাকর্মীদের ওপরও হামলা চালানো হয় এ সময়।
শীর্ষ নেতাদের হত্যা করাই ছিল টার্গেট
জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির শীর্ষ নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যেই গোপালগঞ্জে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী এই প্রস্তুতি নেয়া হয় আগে থেকেই। সে অনুযায়ী বুধবার সকাল থেকেই গোপালগঞ্জের বিভিন্ন পয়েন্ট ও এনসিপির সমাবেশস্থলের আশপাশে অবস্থান নেয় হামলাকারীরা। এর আগের রাতে পুরো জেলার গ্রাম-গঞ্জ থেকে নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের গোপনে জড়ো করা হয় শহরে। ছোট ছোট গ্রুপে তারা শহরের অলিগলিতে অবস্থান নেয় বলে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। এছাড়া ঢাকার অনেক সন্ত্রাসীও ওই রাতে গোপালগঞ্জে যায় কিলিং মিশনে অংশ নেয়ার জন্য। তাদের ক্ষুদে বার্তায় তথ্য দেয়া হয়, এনসিপির নেতারা গোপালগঞ্জে ঢুকলে তারা যেন জীবন নিয়ে ফিরে যেতে না পারে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন এ বিষয়ে আগে থেকে জানলেও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো স্থানীয় পুলিশের পক্ষ থেকে এনসিপিকে ‘সব ঠিক আছে’ বলে জানানো হয়েছিল, এমন অভিযোগ করেছেন দলটির নেতারা। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় পুলিশের কেউ কেউ এই হামলার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকতে পারে।
এনসিপির গাড়িবহরে থাকা এক নেতা আরিফুর রহমান তুহিন তার ফেসবুক পোস্টে এ বিষয়ে বলেছেন, ‘টার্গেট ছিল নাহিদ, হাসনাত ও সার্জিসের গাড়ি। সন্ত্রাসীরা জানতো না যে, আমি ওদেরকে জোর করে এপিসিতে তুলে দিয়েছি। তাই ওরা এই তিনটা গাড়িকে লক্ষ্য করেই গুলি ও বোমা ছুড়ে। রাস্তায় রাস্তায় গান পাউডার ও পেট্রোল ছড়ানো ছিল। সর্বত্র গাছ ফেলে রাখা হয়। আমি নিজেই নাহিদ ইসলামের গাড়িতে ছিলাম এবং বিকট শব্দে একেকটা বোমা পড়তেছিল।’ অপর এক স্টাটাসে তুহিন বলেন, ‘প্রত্যেকটি জীবনের মূল্য অসীম। এনসিপির পুরো নেতৃত্বকে শেষ করতে এসে ঝরে গেল তাজা চারটি প্রাণ। ওরা কি আর ফিরবে? যাদের কথায় আপনাদের জীবন গেল তারাতো পাশের দেশে আরামে জীবন পার করছে। তারা কেউ হয়তো এদেশে আর আসবেও না। তাহলে কেন এই ধ্বংসলীলায় মাতলেন আপনারা? আমাদের মেরে ফেলে কি লাভ আপনাদের? নিজেদের জীবনকে বাজি ধরছেন একটা ডাইনির জন্য? আমাদের জ্বালিয়ে দিতে প্রায় ২০০ ফিটের মধ্যে চলে এসেছিল তারা। ধরেই নিয়েছিলাম এটাই শেষ দিন। পুরো এনসিপিসহ হয়তো পুড়ে ছারখার হয়ে যেতাম। আল্লাহর রহমতে জীবনটা ফিরে পেলাম সবাই। কিন্তু ঝরে গেল চারটি তাজা জীবন।’
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, যেভাবে সবকিছু করা হয়েছে, তাতে স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় এই হামলা ছিলো নিখুঁত পরিকল্পিত। হামলাকারীরা রাস্তার আশপাশের ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে ছিল। এনসিপির গাড়িগুলো বের হওয়ার পথেই তারা গুলি চালায় ও বোমা নিক্ষেপ করে। এনসিপির অপর এক নেতা বলেছেন, বোমাগুলো নিখুঁতভাবে গাড়িবহরকে টার্গেট করে মারা হয়। ঘটনার পর এনসিপির একাধিক নেতা বলেছেন, এই হামলার ব্যাপারে স্থানীয় পুলিশের কেউ কেউ জড়িত থাকতে পারে। তারা হয়তো আগে থেকেই বিষয়টি জানত। পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের সাথে যখনই যোগাযোগ করা হয়েছে তখনই বলা হয়েছে, ‘সব ঠিকঠাক আছে।’ কিন্তু এনসিপি নেতারা সভাস্থলে যাওয়ার পরই তারা বুঝতে পারেন আসলে কিছুই ঠিক নেই। তারা সমাবেশস্থলে যাওয়ার আগেও একবার হামলা হয়। সমাবেশ সংক্ষিপ্ত করে গাড়িতে ওঠার পরই তাদের কাছে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হামলার পর যখন তারা পাশের স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেন তখন শুনতে পারেন মাইকে ঘোষণা আসছে তাদেরকে হত্যার জন্য।
স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এক বিবৃতিতে বলেছে, অবিলম্বে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কমিটি গঠন করে গোপালগঞ্জের ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান করতে হবে। এনসিপির নেতা ও সমর্থকদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলার পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে হবে। পাশাপাশি সমাবেশে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষের কোনো গাফিলতি ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছে আসক।
গোপালগঞ্জে এনসিপি নেতাদের ওপর হামলার ঘটনায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের গাফলতি নিয়ে এরইমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে। দলটির নেতারা বলেছেন, হামলার সময় পুলিশ তাদেরকে ফেলে রেখে নিজেরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের আচরণ মোটেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। সভা শুরু হওয়ার আগে কিছু সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে সভাস্থলে দেখা যায় চেয়ারে বসে থাকতে। তারা এনসিপির কোনো সদস্য নয়। স্থানীয় এনসিপির সদস্যরা বলেছেন, ওই লোকগুলো গোপালগঞ্জের হলে তারা তাদেরকে চিনতেন। তাদের চেহারাও ছিল একটু অন্য রকম। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আনা হয়েছিলো। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
ঘটনার সময় দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তাদের কার কী দায়িত্ব ছিল এবং কে কী ভূমিকা রেখেছে; কার দায় কতটুকু ছিল, সেটারও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। পর্যালোচনা করা হচ্ছে বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ। পুলিশের দায়িত্বশীল মহল বলছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কারও প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রচলিত বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বুধবারের ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনিকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হিসেবে থাকছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং আইন ও বিচার বিভাগের একজন করে অতিরিক্ত সচিব। পুলিশ আনুষ্ঠানিক কোনো তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দিলেও তারা অভ্যন্তরীণভাবে বিষয়টির বিস্তর অনুসন্ধান করছে। সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের কোনো গাফিলতি বা অবহেলা ছিল কি না, সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাদের সমস্যাগুলোও চিহ্নিত করে প্রতিকারের কাজ চলছে। এ দিকে গোপালগঞ্জের ঘটনায় হামলাকারী কাউকে ছেড়ে দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব:) জাহাঙ্গীর আলম।