স্বাস্থ্য ডেস্ক: বাংলাদেশে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ হেপাটাইটিস বি এবং শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের বাহক। সব মিলিয়ে দেশে এ দুই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। তাদের মধ্যে ১২ থেকে ১৫ শতাংশের লিভার একেবারেই অকেজো। অর্থাৎ তাদের লিভার প্রতিস্থাপন অত্যাবশ্যক। এ ছাড়া অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে লিভারের নানারকম জটিল রোগে ভুগছেন।
খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে এ তথ্য তুলে ধরেছে ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন। এক কথায়, লিভার প্রতিস্থাপন প্রয়োজন, দেশে এমন মানুষের সংখ্যা কয়েক লাখ। অথচ উদ্বেগজনক হলেও সত্যি, লিভার প্রতিস্থাপনে অনেক পিছিয়ে আছে দেশের চিকিৎসা খাত। এ দেশে এ পর্যন্ত হাতে গোনা যে কয়েকটি প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হয়েছে, তার সবগুলোতেই বাইরে থেকে সার্জন আনতে হয়েছে। বিত্তশালীরা লিভার প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হলে চলে যাচ্ছেন দেশের বাইরে। কিন্তু সাধারণ মানুষজন, যাদের সেই আর্থিক সক্ষমতা নেই, তারা চিকিৎসা না পেয়ে রোগে ভুগে ভুগে অকালেই প্রাণ হারান।
এ সংকট থেকে উত্তরণে দেড় বছর আগে সরকারি-বেসরকারি একাধিক হাসপাতালে লিভার প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালু করার উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু স্বাস্থ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতাসহ নানাবিধ জটিলতায় সে উদ্যোগ এখনো আলোর মুখ দেখেনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানেই এ পর্যন্ত নিয়মিত লিভার প্রতিস্থাপন চালু করা সম্ভব হয়নি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের হেপাটোলজি বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারুক আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘লিভার প্রতিস্থাপনে প্রয়োজন নিবেদিতপ্রাণ সার্জন, উন্নত নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ), আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ প্রশিক্ষিত জনবল। পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দও থাকা চাই। কিন্তু সরকার তা দিতে পারছে না। এতকিছুর পরও লিভার প্রতিস্থাপনে দাতা পাওয়ার মতো বড় একটি চ্যালেঞ্জ তো রয়েছেই।
তিনি বলেন, দেশে এ পর্যন্ত যে কয়টি প্রতিস্থাপন হয়েছে, তার সবগুলোতেই দেশের বাইরে থেকে সার্জন আনতে হয়েছে। কিন্তু সেগুলো আবার নিয়মিত করা হয়নি। নিয়মিত করা গেলে দেশেই বড় একটি টিম তৈরি হবে। আবাসিক চিকিৎসকদের দেশের বাইরে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে অনেকটা এগোবে। শুধু সরকারি হাসপাতালেই নয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও লিভার প্রতিস্থাপনে অনেক পিছিয়ে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবছর পাঁচ থেকে ছয় হাজার রোগীর লিভার প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হলেও এ পর্যন্ত হয়েছে মাত্র সাতটি। এর মধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেই হয়েছে ৫টি- বারডেম হাসপাতালে ৩টি এবং ল্যাবএইডে ২টি। অন্যদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে হয়েছে দুটি। এর মধ্যে সফল হয়েছে একটি।
নানা প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেই বাংলাদেশে লিভার প্রতিস্থাপনের যাত্রা শুরু হয় বারডেম হাসপাতালের সার্জন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আলীর হাত ধরে। ১৯৯৯ সালে হেপাটো-বিলিয়ারি-পেনক্রিয়াটিক সার্জারি শুরুর মাধ্যমে লিভার প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেন তিনি। দীর্ঘদিন লিভার সাজারির কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনার পর ২০১০ সালের জুন মাসে প্রতিষ্ঠানটিতে দেশের প্রথম সফল লিভার প্রতিস্থাপন হয় তার নেতৃত্বে।
লিভার প্রতিস্থাপনের এই পথিকৃৎ চিকিৎসক আমাদের সময়কে বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী লিভার চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল। দেশে লিভার প্রতিস্থাপনের রোগী দিন দিন বাড়ছে অথচ আমাদের সক্ষমতায় রয়ে গেছে বড় ঘাটতি। ফলে দেশে লিভার প্রতিস্থাপনের যাত্রা শুরু হলেও আমরা খুব বেশি এগোতে পারিনি। এই চিকিৎসায় সার্জন, অ্যানেসথেসিওলজিস্ট, ক্রিটিকার কেয়ার, ইন্টার্ভেনসনিস্ট, হেপাটোলজিস্ট ও অন্যান্য দক্ষ জনবলের সমন্বয়ে গঠিত ডেডিকেটেড একটি টিম থাকতে হয়। প্রয়োজন হয় অত্যন্ত আধুনিক ও ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতির। আবার প্রতিস্থাপন করতে গিয়ে গ্রহীতার চেয়ে দাতাকে রক্ষা করাটাই সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের। তার পরও নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রথম লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট সফলভাবে বারডেম জেনারেল হাসপাতালে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানে সর্বশেষ সফল লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয় ২০২০ সালে।’
অধ্যাপক আলী আরও বলেন, ‘দেশে লিভার সমস্যায় আক্রান্তদের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশের লিভার সিরোসিস হতে পারে। এ পর্যায় থেকে রোগী ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারে কিংবা লিভার অকেজো হয়ে মারা যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে লিভার রোগ অথবা স্বল্পমেয়াদি মারাত্মক লিভার রোগের কারণে লিভারের কার্যকারিতা একেবারে কমে গেলে অথবা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলে লিভার প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়। সাধারণত হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসজনিত লিভার রোগ, ফ্যাটি লিভার থেকে রূপান্তরিত জটিল ন্যাশ, মধ্যপানজনিত লিভার রোগ ইত্যাদি থেকে সৃষ্ট লিভার সিরোসিসই প্রধান কারণ। এ ছাড়া ভাইরাসের সংক্রমণ, কোনো ওষুধ বা মদ্যপানের কারণে হঠাৎ তাৎক্ষণিক লিভারের কার্যকারিতা থেমে গেলে লিভার প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়।’
অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে লিভার প্রতিস্থাপনের মতো জটিল ও ব্যয়বহুল সার্জারি প্রক্রিয়ায় ন্যূনতম ব্যয় প্রায় ২৫ লাখ টাকার মতো হতে পারে। সামগ্রিকভাবে প্রতিস্থাপন, ফলোআপ এবং আনুষঙ্গিক খরচ হিসাবে যা বিদেশের তুলনায় অনেক কম।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, লিভার প্রতিস্থাপনের এমন বেহাল দশায় দরিদ্র রোগীদের জন্য কম খরচে লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য ২০২১ সালের নভেম্বরে রাজধানীর বিএসএমএমইউ, বারডেম ও শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রয়োজনীয় লোকবল, যন্ত্রপাতি ও কী কী সুযোগসুবিধা থাকা দরকার, কোন প্রক্রিয়ায় প্রতিস্থাপন হবেÑ এসব বিস্তারিত লিখে একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠায় অধিদপ্তর। এই প্রজেক্টের ফোকাল পারসন করা হয় অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীকে। অধিদপ্তরের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ৭/৮টি সভাও হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু দেড় বছরেও তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রস্তাবে শুধু লিভারের পাশাপাশি ঢাকা মেডিক্যাল, বিএসএমএমইউ, জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও চট্টগ্রাম মেডিক্যালে কার্ডিয়াক সার্জারি ও কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রতিটি উদ্যোগ বাস্তবায়নে ১০ কোটি টাকার চাহিদার কথা জানান চিকিৎসকরা। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়হীনতায় সেই অর্থ এখনো ছাড় করতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘নিয়মিত লিভার প্রতিস্থাপন অব্যাহত রাখতে উক্ত বিষয়ে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান স্বাস্থ্যবান্ধব সরকার দেশের মানুষের জন্য লিভার প্রতিস্থাপন সেবা প্রদানের লক্ষ্যে তিনটি হাসপাতালে প্রতিস্থাপন শুরু ও চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে, সেটি বাস্তবায়ন করতে পারলে বহু রোগীর জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে।’
দেশের বিভাগীয় মেডিক্যালের পাশাপাশি রাজধানীর টারশিয়ারি ও বিশেষায়িত হাসপাতাল থাকলেও লিভার প্রতিস্থাপনের সক্ষমতা নেই কোনোটিরই। ২০১৯ সালে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে শুরু হলেও সফল না হওয়ায় চালু হয়েও বন্ধ থাকে দুই বছর। দীর্ঘসময় পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে আবারও শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
গত ১ জানুয়ারি ১২ ঘণ্টাব্যাপী লিভার প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচারে সহযোগিতা করেছে এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, ভারতের লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন ও অ্যানেসথেসিয়া টিম।
বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ বলছে, এ সেবাকে সম্প্রসারিত করতে ইতোমধ্যে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে ১০০ শয্যা রাখা হয়েছে। কিন্তু প্রশিক্ষিত লোকবল ও অন্য সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করে এ সেবা চালু করতে আরও এক বছর লাগবে।
বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। ভারতে অন্তত ১৫টি সেন্টারে নিয়মিত প্রতিস্থাপন হচ্ছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ একটি দক্ষ টিম। সেটি না থাকায় বিএসএমএমইউসহ অন্য দুই প্রতিষ্ঠানেও এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। নিয়মিত করতে একটি টিম তৈরি হচ্ছে। ইতোমধ্যে তারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তবে চালু হতে আরও অন্তত বছরখানেক লাগবে।’
চিকিৎসকরা বলছেন, হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসজনিত লিভারে প্রতিবছর বিশে^ ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ আক্রান্ত এবং প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজনের মৃত্যু হয়। প্রতিবছর লিভার প্রতিস্থাপন হয় ৩৮ থেকে ৪০ হাজার রোগীর। এর মধ্যে আমেরিকা ও ইউরোপেই সর্বোচ্চ। দক্ষিণ এশিয়ায় ৩ থেকে ৪ হাজার রোগীর প্রতিস্থাপন হয়ে থাকে। যার অধিকাংশই ভারতে।
লিভার প্রতিস্থাপনে সরকারের উদ্যোগ কতটা এগিয়েছে, সে বিষয়ে জানার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও সাড়া মেলেনি। ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়, তারও প্রত্যুত্তর পাওয়া যায়নি। আর এ ব্যাপারে ‘কিছুই জানেন না’ বলে জানান স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (হাসপাতাল অনুবিভাগ) মো. নাজমুল হক খান।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম আমাদের সময়কে বলেন, ‘উদ্যোগ আমরাই নিয়েছি। কিন্তু নানা জটিলতায় সেটি খুব বেশি এগোয়নি। লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য একটি প্রস্তাবনা আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলাম। অনেকদূর এগিয়েও ছিল। কিন্তু চাহিদামতো অর্থ মন্ত্রণালয় এখনো অর্থ ছাড় করেনি।’
তিনি বলেন, ‘বিকল্প উপায়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করা হয়। পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোতে কীভাবে প্রতিস্থাপন করছে তা নিয়ে যোগাযোগও করা হয়। তারই প্রক্রিয়া হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের একটি টিমের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। চলতি বছরের জুন মাসে তাদের বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে।’